ঢাকা ০৯:৩৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫, ১৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
এই মাত্র পাওয়াঃ
বাজার মনিটরিং এর কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে, আগামী কোরবানির ঈদেও বাজার মূল্য স্থিতি থাকবে: মাহবুবুর রহমান, সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় পিএসসিকে চাপ দেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছে: উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভুঁইয়া ডিএসসিসি’র ব্যাটারির দরপত্রে অনিয়ম  :  কর্পোরেশনের ২০ লাখ টাকা গচ্চা এলজিইডির সদর দপ্তরসহ একযোগে ৩৬ অফিসে দুদকের অভিযান মৌলভীবাজারে ডাকাতির ঘটনায় ৫ডাকাতসহ গ্রেফতার-৭: অস্ত্র, গুলি, লুণ্ঠিত টাকা ও স্বর্ণালংকার উদ্ধার রেললাইনের পাশে পড়েছিল ব্যবসায়ীর গলাকাটা মরদেহ নাগরপুরে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তিরছা ব্রিকসের বিরুদ্ধে মানববন্ধন ইউএসটিসিতে থ্যালাসেমিয়া বিষয়ক সচেতনতামূলক সেমিনার ও ফ্রি স্ক্রিনিং ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত কমলগঞ্জে ইকবাল হত্যার বিচার ও আসামিদের গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন মৌলভীবাজার পৈলভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজে দুর্নীতি: ঠিকাদারের সাথে এলজিইডি কর্মকর্তারা জড়িত জাতীয় আইন সহায়তা দিবস উপলক্ষে সুনামগঞ্জে র‍্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা নদী ভাঙনে ১৫টি ঘর বিলীন, দেড়শ পরিবার নিঃস্ব

১৫০ জাহাজে প্রতিদিন ৩০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি

ঢাকা, চট্টগ্রাম, মংলা, খুলনা, পায়রা বন্দরসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে পাবনার নগরবাড়ি ও সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি বন্দরে নৌপথে যাবার সময় জাহাজগুলোতে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এতে অরক্ষিত নৌপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে জাহাজ চালক ও শ্রমিকরা।

এসব নৌরুটে চলাচল করে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত ১৫০টি পণ্যবাহী জাহাজ। তার মধ্যে পাবনার নগরবাড়ি ও সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি নদী বন্দরে প্রতিদিন নোঙর করে ১০ থেকে ১২টি জাহাজ।

নদী পথে যেতে যেতে দশটি পয়েন্টে জাহাজ প্রতি চাঁদা দিতে হয় ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা। সব পয়েন্ট মিলিয়ে একেকটি জাহাজ গন্তব্যে পৌঁছাতে চাঁদা গুনতে হয় কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। আর এসব পয়েন্টে প্রতিদিন ১৫০টি জাহাজ থেকে চাঁদা আদায় হয় অন্তত ৩০ লাখ টাকা। এসব চাঁদার টাকা যায় বিভিন্ন স্থানের নৌ পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্রের হাতে।

পাবনার নগরবাড়ি নদীবন্দর সরেজমিন ঘুরে ভুক্তভোগী জাহাজ চালক ও শ্রমিকদের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শুধু চাঁদাবাজিই নয়, প্রায়ই ডাকাতি হয় এসব জাহাজে। চাঁদা না দিলে ডাকাতদের কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াতে হয় চালক শ্রমিকদের। এছাড়া শ্রমিককে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীদের। নৌপথে এমন নৈরাজ্য চললেও প্রাণের ভয়ে অভিযোগ করার সাহস পান না ভুক্তভোগীরা।

নগরবাড়ি ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ নোঙর করে আছে। নৌযান শ্রমিকরা মালামাল খালাস করছেন। যন্ত্রের সাহায্যে একটি জাহাজ থেকে কয়লা খালাস করা হচ্ছে। কোনো জাহাজ দু’দিন, কোনো জাহাজ এক সপ্তাহ ধরে এখানে অবস্থান করছে। পণ্য খালাসে সময় লাগায় জাহাজ চালক শ্রমিকরা অলস সময় পাড় করছেন। এর মাঝে কথা হয় কয়েকজন জাহাজ চালক ও মাস্টারের সাথে।

তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, মংলা, খুলনা, পায়রা বন্দরসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে জাহাজগুলো বিভিন্ন বন্দরে যায়। কয়লা, সার, তেল, পাথর সিমেন্ট নিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১২টি জাহাজ নগরবাড়ি ও বাঘাবাড়ি বন্দরে যায়। পথে কয়েকটি ঘাটে সরকারি চাঁদা দেওয়ার পাশাপাশি অন্তত দশটি পয়েন্টে পথে পথে চাঁদা দিতে হয় ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা। সুযোগ পেলে কখনো ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। এর মধ্যে চাঁদপুর, চাঁদপুর টাওয়ার, চাঁদপুর হরিনা ফেরিঘাট, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর রুটে মাঝের চর, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের সাহারা বিকন, কালিগঞ্জ, মল্লিকপুর, দড়ির চর, হিজলা, ভোলার তোলাতুলি উল্লেখযোগ্য।

আলাপকালে জাবালে নূর জাহাজের চালক বিল্লাল হোসেন বলেন, মংলা থেকে সার নিয়ে আসছি এক সপ্তাহ আগে। খালাস করে চাউল লোড করে নিয়ে যাবো পটুয়াখালীর রাঙাবালীতে। জাহাজ নিয়ে আসার পথে ওইসব পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়৷ জাহাজ প্রতি ৩০০ টাকা থেকে যার কাছে যেমন পারে চাঁদা নেয় নৌ পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে এসে তারা ডিউটির কথা বলে চাঁদাবাজি করে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের লোকজন এসব চাঁদাবাজির সাথে জড়িত। চাঁদা না দিলে ডাকাতি করে।

তিনি জানান, তিন মাস আগে মেহেন্দিগঞ্জ মল্লিকপুর থেকে আমাদের এক শ্রমিককে অপহরণ করে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে বিকাশে ২৭ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ওই শ্রমিককে মুক্ত করি। নৌ পুলিশ বা কোস্টাগার্ড আমাদের নিরাপত্তা দেয় না। আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চলাচল করি।

মাস্টার হারুন নেছা জাহাজের চালক কাজী আহম্মদ আলী বলেন, আমরা চাঁদাবাজির অভিযোগ দিয়ে কি করবো। অভিযোগ বা জিডি করলে প্রাণনাশের হুমকি থাকে। আমরা সারাদিন রাত জাহাজে কাটাই। অভিযোগ দেওয়ার সময় পাই না। চাঁদাবাজিই শুধু নয়, ডাকাতদল নিয়েও আমরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকি। চাঁদা না দিলে ডাকাতি করবে বলে হুমকি দেয়। আমার জীবনে তিনবার ডাকাতের কবলে পড়েছি। জাহাজে যার কাছে যা থাকে লুট করে নিয়ে যায়। নৌ পুলিশ কোস্টগার্ড যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, তারা তো নিরাপত্তা দিতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, কখনো পুলিশ সেজে আসে, পুলিশের পোষাক পড়ে এসে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করে। তবে বেশি সমস্যা, স্থানীয় জেলেরা ডাকাতি করে। তারা রাতের বেলায় বেশি চাঁদাবাজি করে। পাবনায় পদ্মা নদীতে কোথাও চাঁদা দিতে হয়নি বলে জানান তিনি।

জাবালে নূর জাহাজের মাস্টার তোরাব মোল্লা বলেন, কোটি কোটি টাকা পণ্য নিয়ে আমরা নৌপথে চলাচল করি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অথচ পথে পথে চাঁদা দিতে হয়। মাঝে মধ্যে ডাকাতের কবলে পড়তে হয়। কোনো নিরাপত্তা নাই। নৌ পুলিশ হঠাৎ দেখা যায়। বলা ভালো, জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে চলতে হয়। এই যেমন হত শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে নারায়নগঞ্জের ধর্মগঞ্জে ঘাটে বেধে রাখা এমভি ওশান স্টার জাহাজে ডাকাতি হয়েছে। নগদ ৬০ হাজার টাকা ও ১৫টি মোবাইল নিয়ে গেছে। তাহলে আমরা কোথায় কার কাছে যাবো? আমরা কি নিরাপত্তা পাবো না! সরকার কি কোনো ব্যবস্থা নেবে না?

এমভি মনসুর পরিবহনের মাস্টার নান্না ব্যাপারী বলেন, মংলা থেকে সার নিয়ে নগরবাড়ি আসছি। আসার পথে বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়ার নৌ পুলিশ চাঁদা নিয়েছে এক হাজার টাকা। কাগজপত্র আমাদের থাক বা না থাক তাদের চাঁদা দিতে হবে এটা তাদের আইন। কিছু ঘাটের সরকারি চাঁদা নেয় রশিদ দিয়ে, কিন্তু বেশিরভাগ চাঁদারই কোনো রশিদ দেয় না।

কারা চাঁদা নেয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগের লোকজন, নৌ পুলিশ ও কোস্টাগার্ড চাঁদা নিয়েছে। এখন বিএনপির লোকজন নিচ্ছে। তাদের তো নাম পরিচয় জানি না। নদীর মধ্যে থাকি, তারা এসে নিয়ে যায়। তবে পাবনা জেলার মধ্যে এই নৌরুটে এসে কখনো চাঁদাবাজদের কবলে পড়তে হয়নি।

এ বিষয়ে কথা বলতে নগরবাড়ি নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আতিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলা নিষেধ আছে। তাই কথা বলতে পারছি না। আমাদের নৌ পুলিশ রাজশাহীর মিডিয়াসেলের সাথে যোগাযোগ করুন।

রাজশাহী নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সাদিকুর রহমান বলেন, গত এক বছরের মধ্যে পাবনায় নৌ পুলিশ কর্তৃক কোনো চাঁদাবাজি বা ডাকাতির ঘটনা নাই। এমন অভিযোগও আমরা পাইনি। যদি আপনাদের কাছে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে আমাদের জানালে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরো জানান, তবে দেড় বছর আগে নগরবাড়ি নৌ পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ (বর্তমানে নাজিরগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত) শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে মামলা হয়েছে, আদালতে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

পাবনার নগরবাড়ি নৌ বন্দর কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াকিল বলেন, নগরাবাড়ি নৌবন্দরে কোনো চাঁদাবাজির অভিযোগ নেই। আমরা এ বিষয়ে সবসময় তৎপর রয়েছি। নৌ পুলিশ, স্থানীয় ব্যবসায়ী, শ্রমিক, জাহাজ চালক সবার সাথে কথা বলে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। এই নদীবন্দর ঘিরে কোনোরূপ অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। যদি কেউ অভিযোগ করেন তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

বাজার মনিটরিং এর কারণে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে, আগামী কোরবানির ঈদেও বাজার মূল্য স্থিতি থাকবে: মাহবুবুর রহমান, সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়

Verified by MonsterInsights

১৫০ জাহাজে প্রতিদিন ৩০ লাখ টাকার চাঁদাবাজি

আপডেট সময় ০৯:০৮:৩৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪

ঢাকা, চট্টগ্রাম, মংলা, খুলনা, পায়রা বন্দরসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে পাবনার নগরবাড়ি ও সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি বন্দরে নৌপথে যাবার সময় জাহাজগুলোতে ব্যাপক চাঁদাবাজি ও ডাকাতির ঘটনা ঘটে। এতে অরক্ষিত নৌপথে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে জাহাজ চালক ও শ্রমিকরা।

এসব নৌরুটে চলাচল করে ছোট বড় মিলিয়ে অন্তত ১৫০টি পণ্যবাহী জাহাজ। তার মধ্যে পাবনার নগরবাড়ি ও সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ি নদী বন্দরে প্রতিদিন নোঙর করে ১০ থেকে ১২টি জাহাজ।

নদী পথে যেতে যেতে দশটি পয়েন্টে জাহাজ প্রতি চাঁদা দিতে হয় ৩০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা। সব পয়েন্ট মিলিয়ে একেকটি জাহাজ গন্তব্যে পৌঁছাতে চাঁদা গুনতে হয় কমপক্ষে ২০ হাজার টাকা। আর এসব পয়েন্টে প্রতিদিন ১৫০টি জাহাজ থেকে চাঁদা আদায় হয় অন্তত ৩০ লাখ টাকা। এসব চাঁদার টাকা যায় বিভিন্ন স্থানের নৌ পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালী একটি চক্রের হাতে।

পাবনার নগরবাড়ি নদীবন্দর সরেজমিন ঘুরে ভুক্তভোগী জাহাজ চালক ও শ্রমিকদের সাথে আলাপকালে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শুধু চাঁদাবাজিই নয়, প্রায়ই ডাকাতি হয় এসব জাহাজে। চাঁদা না দিলে ডাকাতদের কবলে পড়ে সর্বস্ব খোয়াতে হয় চালক শ্রমিকদের। এছাড়া শ্রমিককে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে ভুক্তভোগীদের। নৌপথে এমন নৈরাজ্য চললেও প্রাণের ভয়ে অভিযোগ করার সাহস পান না ভুক্তভোগীরা।

নগরবাড়ি ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ নোঙর করে আছে। নৌযান শ্রমিকরা মালামাল খালাস করছেন। যন্ত্রের সাহায্যে একটি জাহাজ থেকে কয়লা খালাস করা হচ্ছে। কোনো জাহাজ দু’দিন, কোনো জাহাজ এক সপ্তাহ ধরে এখানে অবস্থান করছে। পণ্য খালাসে সময় লাগায় জাহাজ চালক শ্রমিকরা অলস সময় পাড় করছেন। এর মাঝে কথা হয় কয়েকজন জাহাজ চালক ও মাস্টারের সাথে।

তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, মংলা, খুলনা, পায়রা বন্দরসহ বিভিন্ন বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে জাহাজগুলো বিভিন্ন বন্দরে যায়। কয়লা, সার, তেল, পাথর সিমেন্ট নিয়ে প্রতিদিন গড়ে ১২টি জাহাজ নগরবাড়ি ও বাঘাবাড়ি বন্দরে যায়। পথে কয়েকটি ঘাটে সরকারি চাঁদা দেওয়ার পাশাপাশি অন্তত দশটি পয়েন্টে পথে পথে চাঁদা দিতে হয় ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা। সুযোগ পেলে কখনো ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। এর মধ্যে চাঁদপুর, চাঁদপুর টাওয়ার, চাঁদপুর হরিনা ফেরিঘাট, চাঁদপুর ও শরীয়তপুর রুটে মাঝের চর, বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের সাহারা বিকন, কালিগঞ্জ, মল্লিকপুর, দড়ির চর, হিজলা, ভোলার তোলাতুলি উল্লেখযোগ্য।

আলাপকালে জাবালে নূর জাহাজের চালক বিল্লাল হোসেন বলেন, মংলা থেকে সার নিয়ে আসছি এক সপ্তাহ আগে। খালাস করে চাউল লোড করে নিয়ে যাবো পটুয়াখালীর রাঙাবালীতে। জাহাজ নিয়ে আসার পথে ওইসব পয়েন্টে চাঁদা দিতে হয়৷ জাহাজ প্রতি ৩০০ টাকা থেকে যার কাছে যেমন পারে চাঁদা নেয় নৌ পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ট্রলার ও স্পিডবোট নিয়ে এসে তারা ডিউটির কথা বলে চাঁদাবাজি করে। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের লোকজন এসব চাঁদাবাজির সাথে জড়িত। চাঁদা না দিলে ডাকাতি করে।

তিনি জানান, তিন মাস আগে মেহেন্দিগঞ্জ মল্লিকপুর থেকে আমাদের এক শ্রমিককে অপহরণ করে ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে বিকাশে ২৭ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে ওই শ্রমিককে মুক্ত করি। নৌ পুলিশ বা কোস্টাগার্ড আমাদের নিরাপত্তা দেয় না। আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে চলাচল করি।

মাস্টার হারুন নেছা জাহাজের চালক কাজী আহম্মদ আলী বলেন, আমরা চাঁদাবাজির অভিযোগ দিয়ে কি করবো। অভিযোগ বা জিডি করলে প্রাণনাশের হুমকি থাকে। আমরা সারাদিন রাত জাহাজে কাটাই। অভিযোগ দেওয়ার সময় পাই না। চাঁদাবাজিই শুধু নয়, ডাকাতদল নিয়েও আমরা নিরাপত্তাহীনতায় থাকি। চাঁদা না দিলে ডাকাতি করবে বলে হুমকি দেয়। আমার জীবনে তিনবার ডাকাতের কবলে পড়েছি। জাহাজে যার কাছে যা থাকে লুট করে নিয়ে যায়। নৌ পুলিশ কোস্টগার্ড যাদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, তারা তো নিরাপত্তা দিতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, কখনো পুলিশ সেজে আসে, পুলিশের পোষাক পড়ে এসে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করে। তবে বেশি সমস্যা, স্থানীয় জেলেরা ডাকাতি করে। তারা রাতের বেলায় বেশি চাঁদাবাজি করে। পাবনায় পদ্মা নদীতে কোথাও চাঁদা দিতে হয়নি বলে জানান তিনি।

জাবালে নূর জাহাজের মাস্টার তোরাব মোল্লা বলেন, কোটি কোটি টাকা পণ্য নিয়ে আমরা নৌপথে চলাচল করি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অথচ পথে পথে চাঁদা দিতে হয়। মাঝে মধ্যে ডাকাতের কবলে পড়তে হয়। কোনো নিরাপত্তা নাই। নৌ পুলিশ হঠাৎ দেখা যায়। বলা ভালো, জীবন হাতের মুঠোয় নিয়ে চলতে হয়। এই যেমন হত শুক্রবার (২৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে নারায়নগঞ্জের ধর্মগঞ্জে ঘাটে বেধে রাখা এমভি ওশান স্টার জাহাজে ডাকাতি হয়েছে। নগদ ৬০ হাজার টাকা ও ১৫টি মোবাইল নিয়ে গেছে। তাহলে আমরা কোথায় কার কাছে যাবো? আমরা কি নিরাপত্তা পাবো না! সরকার কি কোনো ব্যবস্থা নেবে না?

এমভি মনসুর পরিবহনের মাস্টার নান্না ব্যাপারী বলেন, মংলা থেকে সার নিয়ে নগরবাড়ি আসছি। আসার পথে বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় ২০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। এর মধ্যে মাওয়ার নৌ পুলিশ চাঁদা নিয়েছে এক হাজার টাকা। কাগজপত্র আমাদের থাক বা না থাক তাদের চাঁদা দিতে হবে এটা তাদের আইন। কিছু ঘাটের সরকারি চাঁদা নেয় রশিদ দিয়ে, কিন্তু বেশিরভাগ চাঁদারই কোনো রশিদ দেয় না।

কারা চাঁদা নেয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগের লোকজন, নৌ পুলিশ ও কোস্টাগার্ড চাঁদা নিয়েছে। এখন বিএনপির লোকজন নিচ্ছে। তাদের তো নাম পরিচয় জানি না। নদীর মধ্যে থাকি, তারা এসে নিয়ে যায়। তবে পাবনা জেলার মধ্যে এই নৌরুটে এসে কখনো চাঁদাবাজদের কবলে পড়তে হয়নি।

এ বিষয়ে কথা বলতে নগরবাড়ি নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আতিকুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কথা বলা নিষেধ আছে। তাই কথা বলতে পারছি না। আমাদের নৌ পুলিশ রাজশাহীর মিডিয়াসেলের সাথে যোগাযোগ করুন।

রাজশাহী নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. সাদিকুর রহমান বলেন, গত এক বছরের মধ্যে পাবনায় নৌ পুলিশ কর্তৃক কোনো চাঁদাবাজি বা ডাকাতির ঘটনা নাই। এমন অভিযোগও আমরা পাইনি। যদি আপনাদের কাছে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকে তাহলে আমাদের জানালে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

তিনি আরো জানান, তবে দেড় বছর আগে নগরবাড়ি নৌ পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন ইনচার্জ (বর্তমানে নাজিরগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়িতে কর্মরত) শরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল। সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে মামলা হয়েছে, আদালতে চার্জশিটও দেওয়া হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

পাবনার নগরবাড়ি নৌ বন্দর কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াকিল বলেন, নগরাবাড়ি নৌবন্দরে কোনো চাঁদাবাজির অভিযোগ নেই। আমরা এ বিষয়ে সবসময় তৎপর রয়েছি। নৌ পুলিশ, স্থানীয় ব্যবসায়ী, শ্রমিক, জাহাজ চালক সবার সাথে কথা বলে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়া হচ্ছে। এই নদীবন্দর ঘিরে কোনোরূপ অপ্রীতিকর ঘটনা যাতে না ঘটে সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। যদি কেউ অভিযোগ করেন তার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।