স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা জনগণের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। গণতন্ত্র ও স্থানীয় সরকারের দাবি সবসময়ই পরস্পরকে গতিময় করেছে। গণতান্ত্রিক ধারণার উপর ভিত্তি করে একটি স্থানীয় সংস্থার প্রতিনিধি জনগণের স্বার্থকে তুলে ধরতে পারে। নির্বাচিত প্রশাসনের সাথে প্রতিটি স্তরের প্রশাসনে স্থানীয় সরকার সংস্থার সংযোগ স্থাপন করা অপরিহার্য।
বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৫৯ ও ৬০-এ একটি স্থানীয় সরকারের আউটলাইন রয়েছে, যা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা বর্ণনা করে যাতে প্রশাসন প্রতিটি ইউনিটের জন্য জনগণকে কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করাতে পারে। সাংবিধানিক প্রয়োজনের অনুপাতে এবং সব অঞ্চলে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ প্রদান করার জন্য কার্যকর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক।
বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের বিবর্তন
বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ইতিহাস দেখায় যে, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সময়সীমার মধ্যে গ্রাম, থানা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে স্থানীয় সংস্থা গঠনের জন্য আইন / অধ্যাদেশ তৈরি করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠার পর স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের কার্য ও দায়িত্বের মধ্যে প্রায়ই পরিবর্তন ঘটায়।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বাংলাদেশে স্থানীয় সরকারের বর্তমান কাঠামোটির উদ্ভব ঘটে। উনিশ শতকের শেষভাগে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠার প্রথম প্রচেষ্টার সৃষ্টি হয়। স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, ফাংশন এবং আর্থিক ব্যবস্থাপনায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের তুলনায় আজকের দিনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ইতিহাসে দেখা যায় যে, উপনিবেশিক শাসনের পূর্বে গ্রামগুলো স্বনির্ভরশীল ছিল। পঞ্চায়েত নামে পরিচিত প্রতিটি গ্রামের নিজস্ব কমিউনিটি ভিত্তিক সংগঠন ছিল। গ্রামীণ সমাজের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য এটি গঠন করেছেন। সামাজিক বিষয়সমূহের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব ছিল। পঞ্চায়েতরা তাদের ঐতিহ্যবাহী কার্য সম্পাদনের জন্য সম্পদ সংগ্রহ করতে পারত ও ব্যবহার করত। পঞ্চায়েত স্বাভাবিকভাবেই জনমতের উপর ভিত্তি করে সমাজের সামাজিক চাহিদা পূরণ করত। তাদের পেছনে কোন আইনি ভিত্তি বা কর্তৃপক্ষ ছিল না।
ব্রিটিশ শাসনের সময় ১৮৭০ সালে বাংলার গ্রাম চৌকিদারি আইন পাস হয় প্রশাসনিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। তখন আইন অনুযায়ী স্থানীয় সরকার সংস্থা প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। এই আইনের অধীনে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি ইউনিয়ন এবং চৌকিদারি পঞ্চায়েত (সংগঠন) গঠিত হয়। চৌকিদারি পঞ্চায়েতটির পাঁচ সদস্য ছিলেন যারা সরকার কর্তৃক তিন বছরের জন্য নিযুক্ত ছিলেন। পঞ্চায়েতগুলি আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য চৌকিদারদের (গ্রাম পুলিশ) নিয়োগের দায়িত্বে ছিল। গ্রামবাসীদের কাছ থেকে কর সংগ্রহের মাধ্যমে চৌকিদারদের অর্থ প্রদান করা হতো।
চৌকিদারি ব্যবস্থার অধীনে সদস্যগণ গ্রামবাসীদের প্রতিনিধির পরিবর্তে সরকারি কর্মচারী হিসেবে বিবেচিত হতো। আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য এবং কর সংগ্রহের জন্য প্রশাসনকে সহায়তা করার জন্য প্রধানত পঞ্চায়েতগুলি ব্যবহার করা হতো। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তাদের কোন ভূমিকা ছিল না। এ কারণেই স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলির অধিক দায়িত্ব পালনের চৌকিদার পঞ্চায়েত ব্যবস্থার পরিবর্তন অনুভব করা হচ্ছিল। এই প্রেক্ষিতে ১৮৮৫ সালে কর্তৃপক্ষ Bengal Local Self Government Act আইন পাস করেন। এই আইনের অধীনে ইউনিয়ন কমিটি, স্থানীয় সরকার বোর্ড এবং জেলা বোর্ড গঠিত হয়।
১৯১৯ সালের The Bengal Village Self-Government Act আইনটি চৌকিদার পঞ্চায়েত ও ইউনিয়ন কমিটি বিলুপ্ত করে এবং তাদের জায়গায় ইউনিয়ন বোর্ড ও জেলা বোর্ড গঠন করে। ইউনিয়ন বোর্ডের দুই-তৃতীয়াংশ নির্বাচিত এবং এক-তৃতীয়াংশ মনোনীত হতো। মনোনয়ন পদ্ধতিটি ১৯৪৬ সালে বিলুপ্ত করা হয়। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যক্রম ছিল আইনশৃঙ্খলা, সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, দাতব্য চিকিৎসালয় এবং প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা; জেলা বোর্ডের দায়িত্ব ছিল পানি সরবরাহ এবং জেলা বোর্ডকে সহায়তা প্রদান। ইউনিয়ন বোর্ড ছোট ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তি করতে পারত এবং ইউনিয়ন কর হার প্রয়োগ করার অধিকার ছিল।
পাকিস্তান সময়কালে ১৯৫৯ সালের Basic Democracy Order আইনের অধীনে স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলি চারটি স্তরে স্থাপন করা হয়েছিল—ইউনিয়ন পরিষদ, থানা কাউন্সিল, জেলা পরিষদ এবং বিভাগীয় কাউন্সিল। গড়ে একটি ইউনিয়নে ১০,০০০ অধিবাসী ছিল এবং ইউনিয়ন কাউন্সিল ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হতো। সদস্যদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটার দ্বারা নির্বাচিত হতো এবং এক-তৃতীয়াংশ সরকার কর্তৃক মনোনীত হতো। সংবিধান প্রণয়নের পরও মনোনয়নের ব্যবস্থা বাতিল করা হয়নি। তাদের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান এবং একজন ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হতো। ইউনিয়ন কাউন্সিলের ৩৭টি কার্যাবলীর মধ্যে কৃষি উন্নয়ন, পানি সরবরাহ, শিক্ষা, যোগাযোগ, সামাজিক কল্যাণ অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৬১ সালের Muslim Family and Marriage Ordinance আইন অনুসারে ইউনিয়ন কাউন্সিলকে সমঝোতা আদালত প্রতিষ্ঠার ক্ষমতা এবং সদস্যদের বিচার বিভাগীয় ক্ষমতা দেওয়া হয়। ইউনিয়ন পরিষদকে নিজস্ব তহবিল গঠনের জন্য সম্পত্তি ও অন্যান্য উৎসের উপর কর আরোপ করার অনুমতি দেওয়া হয়।
থানা কাউন্সিল জনসাধারণের প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে গঠিত হতো। থানাতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা প্রতিনিধি সদস্য হিসেবে থাকতেন এবং সকল উপ-বিভাগীয় কর্মকর্তা ও থানা পর্যায়ের কর্মকর্তারা সদস্য হতেন। উপ-বিভাগীয় কর্মকর্তা ও সার্কেল অফিসার (উন্নয়ন) যথাক্রমে থানা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান হতেন। থানা কাউন্সিলের দায়িত্ব ছিল:
(১) থানা এলাকায় সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সমন্বয় করা;
(২) উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন;
(৩) উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন;
(৪) ইউনিয়ন পরিষদকে তাদের কার্যক্রমে সহায়তা করা;
(৫) পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম প্রচার;
(৬) পরিবেশ বিষয়ক কার্যক্রম এবং
(৭) চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা।
তবে থানা কাউন্সিলের কর আরোপ ও তহবিল সংগ্রহের কোনো ক্ষমতা ছিল না এবং সব খরচ সরকার বহন করত।
জেলা কাউন্সিল আনুষ্ঠানিক ও মনোনীত সদস্যদের নিয়ে গঠিত হতো। সদস্যদের অর্ধেক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও নগর কমিটি দ্বারা নির্বাচিত হতেন এবং বাকি অর্ধেক সরকার নিযুক্ত করত। জেলা প্রশাসক পদাধিকার বলে জেলা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হতেন। জেলা কাউন্সিলের কার্যাবলীর মধ্যে ছিল সড়ক নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, হাসপাতাল নির্মাণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন, বিশ্রামাগার এবং জেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমের সমন্বয়। এছাড়া, জেলা কাউন্সিলকে ট্যাক্স, ফি, টোল প্রভৃতির মাধ্যমে তহবিল গঠনের ক্ষমতা ছিল।
বিভাগীয় কমিশন গঠিত হতো সরকারি ও বেসরকারি সদস্যদের নিয়ে, বিভাগীয় কমিশনার এর চেয়ারম্যান হতেন। এই কমিশনের নির্দিষ্ট কোনো কার্যাবলি না থাকলেও বিভাগে স্থানীয় সরকারের কার্যক্রম সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল। ব্রিটিশ আমলের স্বশাসিত পঞ্চায়েতগুলোকে “ছোট প্রজাতন্ত্র” বলা হতো, যা ঔপনিবেশিক শাসনের ফলে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
১৮৭০ সালে ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কারণে গ্রামে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান চালু করেন। ১৮৮৫ সালের Bengal Local Self Government Act-এর মাধ্যমে ইউনিয়ন কমিটি, স্থানীয় বোর্ড ও জেলা বোর্ড গঠিত হয়। সদস্যরা ছিলেন নির্বাচিত ও মনোনীত উভয় ধরণের, কিন্তু তাদের কোন স্বায়ত্তশাসন ছিল না। পাকিস্তানি যুগে প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম পরিবর্তন হলেও স্বায়ত্তশাসনের খুব একটা উন্নতি হয়নি।
স্বাধীনতার পর তিন স্তরের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গঠনের পাশাপাশি নারী সদস্যদের জন্য বিধান রাখা হয়। ১৯৮২ সালে উপজেলা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হলেও তা ১৯৯১ সালে বিলুপ্ত হয়। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলো আইনশৃঙ্খলা, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার দায়িত্ব পালন করলেও তারা সরকারের অনুদানের উপর নির্ভরশীল ছিল।
বর্তমানে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন। সরকার প্রশাসন ও উন্নয়নে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। স্থানীয় সরকার বিভাগ দারিদ্র্য বিমোচন ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
এলজিডি কার্যক্রম দেশের তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। এর অধীনে ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশন অন্তর্ভুক্ত। পাশাপাশি এলজিইডি, ডিপিএইচই, ওয়াসা সমূহ, জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটও এর অংশ। এরা অবকাঠামো উন্নয়ন, পানি সরবরাহ, বর্জ্য নিষ্পত্তি, স্যানিটেশন, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে সহায়তা করছে।
স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকারিতা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির জন্য কর্মক্ষমতা মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এর ভিত্তিতে অতিরিক্ত বরাদ্দ ও পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
এলজিইডি গ্রামীণ ও শহুরে অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য সড়ক, সেতু, কালভার্ট, বাজার, বাস টার্মিনাল, ঘূর্ণিঝড়/বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পরিচালনা করছে।
ঢাকা ওয়াসা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পানি সরবরাহ, পয়ঃনিষ্কাশন ও ড্রেনেজের দায়িত্ব পালন করছে।
১২টি সিটি কর্পোরেশন ও ৩২৭টি পৌরসভা নাগরিক সেবা প্রদান করছে।