যেখানে শিক্ষার আলো জ্বলার কথা, সেখানে যদি দুর্নীতির হয়, তবে তা শুধু দুর্ভাগ্য নয়, জাতিগত ব্যর্থতা।
মৌলভীবাজার কামালপুর ইউনিয়নের পৈলভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৬৮ লাখ টাকা কাজের অনিয়মে অভিযোগ উঠেছে। কাজে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের সাথে এলজিইডি কর্মকর্তারা জড়িত বলে এলাকার সচেতন মহলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
পৈলভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঠিকাদার সন্দীপ বাবুর সাব-ঠিকাদার রব্বান মিয়া ছিলেন। অর্ধেক কাজ করে সে কাজ ফেলে চলে যায়। কাজের প্রথম থেকে আওয়ামী লীগের দাপট দেখিয়ে সাব-ঠিকাদার রব্বান মিয়া ড্রইং মোতাবেক কাজ না করে তার ইচ্ছেমতো কাজ চালিয়ে যায়। তখন এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর (বর্তমানে বদলি) কাজ দেখা-শোনা করতেন। তাকে ম্যানেজ করে কাজে ইচ্ছেমতো অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে ঠিকাদার। বেশিরভাগ কাজ ড্রইং মতো হয়নি। পরে শহীদ মিয়া নামের অন্য সাব-ঠিকাদার কাজ শুরু করেন।
স্কুলের দুর্নীতির বিষয়ে সাংবাদিকদের অবগত করার জন্য কামালপুর ইউনিয়নে বিএনপির কিছু পাতি নেতারা ঠিকাদারের পক্ষ হয়ে কেয়ারটেকারকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে।
এ ব্যাপারে স্কুল কর্তৃপক্ষসহ এলাকার সচেতন মহল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট লিখিত অভিযোগ করলেও নেওয়া হয়নি কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ।
জানা যায়, পৈলভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের জন্য ৬৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৮ সালে টেন্ডার করে এলজিইডি। টেন্ডারে সন্দীপ নামের একজন ঠিকাদার কাজ পেয়ে ২২ সালে রব্বান মিয়া নামের একজন সাব-ঠিকাদার দিয়ে কাজ শুরু করেন। কাজের শুরু থেকেই অনিয়ম হচ্ছে বলে স্কুল কর্তৃপক্ষসহ এলাকাবাসী প্রতিবাদ করেন। ইচ্ছেমতো কাজ চালিয়ে যায়। তখন এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ার আলমগীর (বর্তমানে বদলি) কাজ দেখা-শোনা করতেন। তাকে ম্যানেজ করে কাজে ইচ্ছেমতো অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছে ঠিকাদার। বেশিরভাগ কাজ ড্রইং মতো হয়নি। পরে শহীদ মিয়া নামের অন্য সাব-ঠিকাদার কাজ শুরু করেন।
প্রতিবাদের তোয়াক্কা না করে কাজ চালিয়ে যায় ঠিকাদার রব্বান মিয়া। স্কুল কর্তৃপক্ষ ও এলাকাবাসীর তোলা ছবিতে দেখা যায়, ড্রইং মোতাবেক বিল্ডিংয়ে গ্রেড বিম না দিয়ে মাটি ভরাট করে কাঁদামাটির উপর লিন্টার দেওয়া হয়েছে। ছাদে রডে হুক না দিয়ে এবং রেম রড ছাড়া ঢালাই করা হয়েছে। পরে এলাকাবাসী ও স্কুল কর্তৃপক্ষের প্রতিবাদে আবার ভেঙে করা হয়। লুভারের নিচে বক্স না দিয়ে ২০”x২০” গাঁথুনি করা হয়েছে। গ্রেড বিমে ড্রইং মোতাবেক গ্রিল করে রড ঢোকানোর কথা থাকলেও ৮”x৬” কেটে লিন্টার ঢালাই দেওয়া হয়। সিভিং ছাড়া করা হচ্ছে আস্তর। দেওয়াল আস্তরে প্রমোশনে গড় মিলে অভিযোগ রয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষসহ সচেতন এলাকাবাসীর।
স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলেন, এই পৈলভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজের মধ্যে অনেক ত্রুটি রয়েছে। সরকারের যে সার্কুলার রয়েছে, সেই অনুযায়ী কাজ করার কথা ছিল, কিন্তু তা হয়নি। প্রতিবাদ করেছিলাম স্কুলের ম্যাডামসহ। ১৮ সালের কাজ করার কথা ছিল। আমরা শুনতেছি কাজ হচ্ছে, আবার কাজ বন্ধ হচ্ছে, এইভাবেই চলছে স্কুলের নির্মাণ কাজ। গত বছর কাজ ধরেছে। সিমেন্ট এবং রড আমরা তো সাধারণ মানুষ, বলতে পারব না। যারা কাজ করেছে তারাই ভালো করে জানবে। মাঝে মধ্যে আমরা এসে স্কুলের কাজ দেখি। আমরা সাধারণ মানুষ, এই কাজগুলো দেখার কথা ছিল না, দায়িত্ব যাদের ছিল তাদের দেখার কথা ছিল।
পৈলভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কাজের এ ব্যাপারে স্কুলের কাজের কেয়ারটেকার কামাল খান বলেন, পৈলভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রড ছাড়াই ঢালাই দেওয়া হয়েছে, অতি তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢালাই দেওয়া হয়েছে। আমি বলেছিলাম যে রড ছাড়া কাজ করা হয়েছে। স্কুলের এই ভবনে নির্মাণ কাজে চল্লিশ লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়নি। স্কুলের ভবনে নির্মাণ কাজে নিচ থেকে উপরে সবকিছুই অনিয়মে করা হয়েছে।
পৈলভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবলী সেন বলেন, ড্রইং বই রয়েছে, ড্রইং বইয়ের মধ্যে ১৮ সালের আমি দেখেছি কাজ। ২৪শে জুলাই কাজ শুরু করেছেন। তারপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসে স্কুলের কাজগুলো পরিদর্শন করেন। আমাদের স্কুলের ক্লাসরুম ছয়টি প্রয়োজন ছিল, পরে তিনটা রুম কম করা হয়েছে। আমাদের অফিস রুম কোথায়, আর ক্লাসরুম কোথায়? কাজের গুণমান খুবই খারাপ হয়েছে। কাজের গুণমান সঠিকভাবে হচ্ছে না। স্কুলের কাজে অনিয়ম হচ্ছে জেনে আমরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বরাবরে অভিযোগ করেছি।
ঠিকাদার শহীদ মিয়া বলেন, আমার কিছু করার নেই, আমি কী বলবো। অনিয়ম যদি এই স্কুলের কাজে হয়ে থাকে, তাহলে আমরা আবার কাজ করে দেব। ঠিকাদার সন্দীপের লাইসেন্স দিয়ে আমি কাজ পেয়েছি। সরকার টেন্ডার দিয়েছে। সরকারের কথা অনুযায়ী আমরা কাজ করব, পাবলিকের কথা শুনলে তো আমাদের কাজ হবে না। কেয়ারটেকার কামালের কথায় প্রধান শিক্ষক যেভাবে ইচ্ছা নাচানাচি করছে। বক্স না করার ও গ্রেড বিমে ডিল ঢোকানোর বিষয় স্বীকার করে এর যুক্তি তুলে ধরেন। আর এ বিষয়ে এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ারের সম্মতি ছিল বলে জানান। বাকি কাজ সঠিকভাবে হয়েছে বলে দাবি করেন।
মৌলভীবাজার উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোজাম্মিল বলেন, অনুমোদিত টেন্ডার হয়েছে তিন তলা ফাউন্ডেশন তিন রুমের। রুম তিনটি বাস্তবায়িত হয়েছে। আমরা নিয়মমতো প্রতিদিন কাজ দেখছি এবং কাজ চলমান রয়েছে। এলজিইডি শুক্রবার দিনটাকে ভেরিফাই করে না। অনেক জায়গায় কাজ গিয়ে দেখতে হয়, এটা সন্ধ্যা বা রাত বিষয় না। স্কুলের কাজ ড্রইং মোতাবেক হচ্ছে। এছাড়া কাজ এখনো শেষ হয়নি। অনিয়মের প্রমাণ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আহমেদ আব্দুল্লাহ বলেন, স্কুলের কাজ সঠিকভাবে হচ্ছে। কোনো অনিয়ম হচ্ছে বলে কোনো অভিযোগ পাইনি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও এলাকাবাসীর লিখিত অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে বলেন, আমি অভিযোগ এখনো পাইনি। আর প্রধান শিক্ষক কাজের ড্রইং কী বুঝেন? উনাকে আমার নিকট নিয়ে আসেন। আমাকে ড্রইংটা বুঝিয়ে দিতে। ড্রইং বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব স্কুলের প্রধান শিক্ষকের?
মৌলভীবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তাজ উদ্দিন বলেন, পৈলভাগ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণ কাজের অনিয়ম সম্পর্কে প্রধান শিক্ষিকার কাছ থেকে আমরা অভিযোগ পেয়েছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আমি নিজে পরিদর্শন করেছি। আমার সাথে ছিলেন উপজেলা প্রকৌশলী। পরিদর্শন করেছেন। আর অভিযোগটি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর নিকট পাঠিয়েছি। আমি ঠিকাদারকে সতর্ক করেছি। ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়া চলছে। আশা করি দ্রুত সময়ে সুন্দর একটি সমাধান হবে।