ঢাকা ০৮:৪১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫, ২৮ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই মাত্র পাওয়াঃ
পাকিস্তানে যাত্রীবাহী ট্রেনে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা বিএনপিতে কোনো বেয়াদবের জায়গা থাকবে না: হীরা মানুষের কাজ করতে হবে হৃদয় উজার করে: মহসিন মিয়া মধু পাবনা জেল সুপারের মানবিকতায় কারাগার থেকে নিজ দেশে ফিরে গেলেন নেপালী যুবক পাবনায় শিশু ধর্ষণচেষ্টা মামলায় অভিযুক্ত গ্রেপ্তার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন: পিআইও আবুল কালাম আজাদ ও স্ত্রী-ছেলের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা মির্জাপুরে মহানবী (সা.) কে নিয়ে কটূক্তি করায় যুবক গ্রেপ্তার রমজানে ৫০০ জন রোজাদারদের মাঝে ইফতার বিতরণ করছে “মানুষের পাশে আমরা, যশোর” বিজিবির অভিযানে ২০ লাখ টাকার মাদকসহ আটক ১০ বিবেকের জাগরণ: কখন আসবে আমাদের চেতনার আলো? রাজশাহীতে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, দুর্ভোগে রোগীরা বদলগাছীতে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস উদযাপন
রাজউকের হালচাল পর্ব- ১

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প: পিডি উজ্জ্বল মল্লিক ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে শত শত কোটি টাকার ক্ষতিগ্রস্ত প্লট হাতিয়ে নিয়েছে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • আপডেট সময় ১১:৩১:১৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ৫৭৩ বার পড়া হয়েছে

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে জমির মালিকানার ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে কয়েকশ’ ক্ষতিগ্রস্ত প্লট বরাদ্দ দিয়ে শতশত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর সবচেয়ে বড় প্রকল্প পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প। রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে এই প্রকল্পটি ১৯৯৫ সালে শুরু হয়ে ২০১০ সালে শেষ হওয়ার মূল পরিকল্পনা থাকলেও নানান জটিলতার কারণে এই প্রকল্পটি ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদন দেয় তৎকালিন বিএনপি সরকার। প্রকল্পের শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। পরবর্তীতে বারবার খরচ বাড়িয়ে সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি মুলত ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুর এই তিন জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে বিস্তৃত। প্রকল্পের বড় অংশ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নে। প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী যাদের জমি বা বসত ভিটা এই প্রকল্পে একোয়ার করা হয়েছে তাদের জমি ও স্থাপনা থাকলে তার ন্যায্যমূল্য পরিশোধ করা হবে এবং যদি কেহ প্লট চায় তাকে জমির মালিকানার উপযুক্ত কাগজ দেখিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে প্লটের আবেদন করতে হবে এবং তাদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে।

অনুসন্ধানের দেখা যায়, ওই প্রকল্পের তৎকালীন পিডি উজ্জ্বল মল্লিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে তিন কাঠা ও পাঁচ কাঠা আয়তনের কয়েকশ’ ক্ষতিগ্রস্ত প্লট বরাদ্দ দিয়ে বছরখানেক পর রাজউক থেকে ওই সব প্লট বিক্রির সেল পারমিশন করে সব প্লট মোটা দামে বিক্রি করে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

সূত্র জানায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ ও পাড়াবর্থা মৌজার এল এ কেস নং- ০১/২০০০-২০০১,০৭/২০০১-২০০২ ও ০৩/২০০০-২০০১ এর আওতায় অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকদের মধ্যে তিন ও পাঁচ কাঠা আয়তনের আবাসিক প্লট বরাদ্দের জন্য নামে বেনামে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জমির মালিকানা দাবি করে আবেদন করে।

সূত্র আরও জানায়, ওই সময় নাগরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুল কাদির মিয়া। পিডি উজ্জ্বল মল্লিক কাদির মিয়ার সহায়তায় কাদিরের ভাগিনা অলিউল, শ্যালক, ভায়রা, ভায়রার ছেলে-মেয়ে, শ্বশুর, জেঠাস, বাড়ির কাজের মেয়ে, ড্রাইভারের নামে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন করে এবং বরাদ্দ পায়। অথচ ওদের করো জমি ওই প্রকল্পের আওতায় নাই।

প্রকল্পের ডিপিপিতে উল্লেখ আছে, যাদের পৈত্রিক বা বৈধ ক্রয়কৃত সম্পত্তি বা বসতবাড়ি ওই প্রকল্পে একোয়ার করা হবে শুধুমাত্র তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে নির্ধারিত প্লট পাবে। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, তৎকালীন পিডি উজ্জ্বল মল্লিক কাদির চেয়ারম্যানের সহায়তায় কয়েকশ’ ভুয়া মালিকানা সাজিয়ে তাদের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে আবেদন করে প্লট বাগিয়ে নেয়।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির তার বাড়ির কাজের মেয়ে হাসি আক্তারের নামে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে তিন কাঠার প্লটের আবেদন করে, যার সিরিয়াল নাম্বার ১১৮০ এম আর নাম্বার- ৩৬২৭৩। চেয়ারম্যানের গাড়ির ড্রাইভার মোঃ স্বপন মিয়া, পিতা মৃত উকিল উদ্দিন, মাতা বানেছা আক্তার তার নামে ক্ষতিগ্রস্ত প্লটের তালিকায় পাঁচ কাঠার প্লটের জন্য আবেদন করে, যার সিরিয়াল নাম্বার ১০৬৯, এম আর নাম্বার- ৩৫৬৮৬। ওই চেয়ারম্যানের তিন শ্যালক মোঃ নাজিমুদ্দিন সরকার, নাজির সরকার ও জামান সরকার সর্ব পিতা লেহাজ উদ্দিন সরকার এদের প্রত্যেকের নামে ক্ষতিগ্রস্ত প্লট ক্যাটাগরিতে তিন কাঠার প্লটের আবেদন করে। তাদের আবেদনের সিরিয়াল নাম্বার- ১১৮৪, ১০৫০, ১১৮৩ এবং এম আর নাম্বার- ৩৬২৭৮, ৩৫৬৪২, ৩৬২৭৬।

এছাড়াও কাদিরের ভায়রার ছেলে নাসির সরকারের নামে তিন কাঠা প্লটের আবেদন করে, যার সিরিয়াল নাম্বার- ১০৬৩ এম আর নাম্বার- ৩৫৬৭৭, কাদিরের ভায়রার মেয়ে লূৎফা বেগমের নামেও ওই ক্যাটাগরিতে তিন কাঠার প্লটের আবেদন করে যার সিরিয়াল নাম্বার- ১০৬৪ ও এম আর নাম্বার- ৩৫৬৭৯। এদের কারো জমি বা বসতভিটা পূর্বাচল প্রকল্পে ছিল না।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, কাদির চেয়ারম্যানের আরেক আত্মীয় খাদিজা আক্তার তিশার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে প্লটের আবেদন করেছে, ওই সময় তার জন্মই হয়নি। অথচ তার জমি ও বসতবাড়ি পূর্বাচল প্রকল্পে পড়েছে দেখিয়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্লটের আবেদন করেছে যার সিরিয়াল নাম্বার- ১১৮৫ এবং এম আর নাম্বার- ৩৬২৭৯।তার আরেক আত্মীয় রুনা আক্তার, পিতা- আনোয়ার হোসেন, বাড়ি- রূপগঞ্জ উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে তার নামে তিন কাঠার প্লটের আবেদন করেছে যার সিরিয়াল নাম্বার- ১০৮১, এম আর নাম্বার- ৩৬৭০১।

একইভাবে আনোয়ার হোসেন, পিতা- মৃত শাহাজ উদ্দিন, তার বাড়িও রূপগঞ্জ। তার নামে পাঁচ কাঠার প্লটের আবেদন করে, যার সিরিয়াল নাম্বার- ১০৯২ ও এম আর নাম্বার- ৩৫৭১৩। কাদিরের আরেক আত্মীয় রুনিয়া আক্তার, পিতা- আনোয়ার হোসেন, তার নামে ক্ষতিগ্রস্ত কোটায় তিন কাঠার প্লটের আবেদন করেছে, যার সিরিয়াল নাম্বার- ১০৮০ ও এম আর নাম্বার- ৩৫৬৯৯।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৩০ মে রাজউক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ ও পাড়াবর্থা মৌজায় অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্যে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তিন ও পাঁচ কাঠা আয়োতনের প্লট বরাদ্দের জন্য রাজউক ভবনস্থ সোনালী/অগ্রনী/জনতা ব্যাংক থেকে অফেরতযোগ্য এক হাজার টাকা মূল্যের আবেদনপত্রের ফর্ম ও প্রসপেক্টাস সংগ্রহ করতে। সেই আলোকে পিডি উজ্জ্বল মল্লিক নাগরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদিরের সহায়তায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এল এ শাখার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে নিকট ও দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের নামে জমির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রায় দুই শতাধিক লোকের নামে ক্ষতিগ্রস্ত প্লটের জন্য আবেদন করে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, তাদের কারো জমি বা বসত ভিটা পূর্বাচল প্রকল্পের আওতায় নাই।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, শুধু ক্ষতিগ্রস্ত প্লটের আবেদন নয়, ওই সব ভুয়া কাগজপত্রের আলোকে একোয়ারকৃত রেটে জমির মূল্য উঠিয়ে নেয়। সূত্র জানায়, উজ্জ্বল মল্লিকের সরাসরি হস্তক্ষেপে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জমির মূল্য পরিশোধ করার ব্যবস্থা করে ওই টাকার অর্ধেক উজ্জ্বল মল্লিক নেয়। এই খাত থেকে উজ্জ্বল মল্লিক প্রায় শত কোটি টাকা ভাগ পায়।

ওই সব ভুয়া ক্ষতিগ্রস্তদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দ্রুত তাদের প্লট প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে এবং কয়েক মাসের মধ্যে ওই সব প্লটের সেল পারমিশন বের করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দেয়। সূত্র জানায়, উজ্জ্বল মল্লিক ওই দুই শত প্লট উচ্চমূল্য বিক্রি করে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা ভাগ পায়।

তৎকালীন পিডি উজ্জ্বল মল্লিক পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের কালীগঞ্জ অংশ থেকে ওই পরিমাণন অনৈতিক আয় করে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ অংশে অন্যান্য লোকদের যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে জমির দাম ও ক্ষতিগ্রস্ত প্লট বরাদ্দ দিয়ে এবং পরে তা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আয় করে।

গোপালগঞ্জের জামাই হিসাবে আওয়ামী লীগের শাসনামলের সতের বছরে প্রচন্ড প্রতাপে রাজউক ভবন টতস্ত রাখেন উজ্জ্বল মল্লিক। পূর্বাচল প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি ঢাকতে উজ্জ্বল মল্লিক শেখ সেলিমকে দিয়ে সিনিয়র পাঁচজনকে টপকিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর মসনদ দখল করেন। শেখ সেলিমের প্রভাব খাটিয়ে রাজউক ভবনে ছোট পদে গোপালগঞ্জের অনেকগুলো কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে তাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেন। সাথে সাথে গোপালগঞ্জের নামধারী কিছু সাংবাদিক পালতেন।

প্রধান প্রকৌশলীর পদে আশিন হয়ে উজ্জ্বল মল্লিকের অনিয়ম ও দুর্নীতি আরো বেড়ে যায়। পাঁচ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজউকের নতুন চেয়ারম্যান যোগদানের পর উজ্জ্বল মল্লিককে প্রধান প্রকৌশলীর পদ থেকে সরিয়ে ওএসডি করা হয়।

সূত্র জানায়, উজ্জ্বল মল্লিক অনিয়ম ও দুর্নীতির শত শত কোটি টাকা দিয়ে নিজ এলাকা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বহুতল ভবনের বাড়ি, কক্সবাজারে রিসোর্টসহ কিনেছেন সম্পদের পাহাড়। শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জেও কিনেছেন পঞ্চাশ বিঘা জমি। এখানেই শেষ নয়, হুন্ডির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের টাকা পাচার করেছেন ভারতে। কলকাতার অভিজাত এলাকা সল্টলেকে তার রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। টালিগঞ্জেও রয়েছে বাড়ি ও জমি।

সূত্র জানায়, উজ্জ্বল মল্লিকের স্ত্রী একইসাথে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিক। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে তদন্ত করলে অবৈধ টাকা লেনদেনের প্রমাণ মিলবে।

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিকের বক্তব্য নিতে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি অভিযোগের বিষয়ে অস্বীকার করেন।

ট্যাগস :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

পাকিস্তানে যাত্রীবাহী ট্রেনে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা

Verified by MonsterInsights

রাজউকের হালচাল পর্ব- ১

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প: পিডি উজ্জ্বল মল্লিক ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে শত শত কোটি টাকার ক্ষতিগ্রস্ত প্লট হাতিয়ে নিয়েছে

আপডেট সময় ১১:৩১:১৫ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের সাবেক প্রকল্প পরিচালক উজ্জ্বল মল্লিক মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে জমির মালিকানার ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে কয়েকশ’ ক্ষতিগ্রস্ত প্লট বরাদ্দ দিয়ে শতশত কোটি টাকার বাণিজ্য করেছেন।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর সবচেয়ে বড় প্রকল্প পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প। রাজধানীর জিরো পয়েন্ট থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে এই প্রকল্পটি ১৯৯৫ সালে শুরু হয়ে ২০১০ সালে শেষ হওয়ার মূল পরিকল্পনা থাকলেও নানান জটিলতার কারণে এই প্রকল্পটি ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একনেকে অনুমোদন দেয় তৎকালিন বিএনপি সরকার। প্রকল্পের শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। পরবর্তীতে বারবার খরচ বাড়িয়ে সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পটি মুলত ঢাকা, নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুর এই তিন জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে বিস্তৃত। প্রকল্পের বড় অংশ গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নে। প্রকল্পের ডিপিপি অনুযায়ী যাদের জমি বা বসত ভিটা এই প্রকল্পে একোয়ার করা হয়েছে তাদের জমি ও স্থাপনা থাকলে তার ন্যায্যমূল্য পরিশোধ করা হবে এবং যদি কেহ প্লট চায় তাকে জমির মালিকানার উপযুক্ত কাগজ দেখিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে প্লটের আবেদন করতে হবে এবং তাদের প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে।

অনুসন্ধানের দেখা যায়, ওই প্রকল্পের তৎকালীন পিডি উজ্জ্বল মল্লিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহায়তায় ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে তিন কাঠা ও পাঁচ কাঠা আয়তনের কয়েকশ’ ক্ষতিগ্রস্ত প্লট বরাদ্দ দিয়ে বছরখানেক পর রাজউক থেকে ওই সব প্লট বিক্রির সেল পারমিশন করে সব প্লট মোটা দামে বিক্রি করে কয়েকশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়।

সূত্র জানায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ ও পাড়াবর্থা মৌজার এল এ কেস নং- ০১/২০০০-২০০১,০৭/২০০১-২০০২ ও ০৩/২০০০-২০০১ এর আওতায় অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকদের মধ্যে তিন ও পাঁচ কাঠা আয়তনের আবাসিক প্লট বরাদ্দের জন্য নামে বেনামে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জমির মালিকানা দাবি করে আবেদন করে।

সূত্র আরও জানায়, ওই সময় নাগরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন আব্দুল কাদির মিয়া। পিডি উজ্জ্বল মল্লিক কাদির মিয়ার সহায়তায় কাদিরের ভাগিনা অলিউল, শ্যালক, ভায়রা, ভায়রার ছেলে-মেয়ে, শ্বশুর, জেঠাস, বাড়ির কাজের মেয়ে, ড্রাইভারের নামে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন করে এবং বরাদ্দ পায়। অথচ ওদের করো জমি ওই প্রকল্পের আওতায় নাই।

প্রকল্পের ডিপিপিতে উল্লেখ আছে, যাদের পৈত্রিক বা বৈধ ক্রয়কৃত সম্পত্তি বা বসতবাড়ি ওই প্রকল্পে একোয়ার করা হবে শুধুমাত্র তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে নির্ধারিত প্লট পাবে। কিন্তু অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, তৎকালীন পিডি উজ্জ্বল মল্লিক কাদির চেয়ারম্যানের সহায়তায় কয়েকশ’ ভুয়া মালিকানা সাজিয়ে তাদের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে আবেদন করে প্লট বাগিয়ে নেয়।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, চেয়ারম্যান আব্দুল কাদির তার বাড়ির কাজের মেয়ে হাসি আক্তারের নামে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে তিন কাঠার প্লটের আবেদন করে, যার সিরিয়াল নাম্বার ১১৮০ এম আর নাম্বার- ৩৬২৭৩। চেয়ারম্যানের গাড়ির ড্রাইভার মোঃ স্বপন মিয়া, পিতা মৃত উকিল উদ্দিন, মাতা বানেছা আক্তার তার নামে ক্ষতিগ্রস্ত প্লটের তালিকায় পাঁচ কাঠার প্লটের জন্য আবেদন করে, যার সিরিয়াল নাম্বার ১০৬৯, এম আর নাম্বার- ৩৫৬৮৬। ওই চেয়ারম্যানের তিন শ্যালক মোঃ নাজিমুদ্দিন সরকার, নাজির সরকার ও জামান সরকার সর্ব পিতা লেহাজ উদ্দিন সরকার এদের প্রত্যেকের নামে ক্ষতিগ্রস্ত প্লট ক্যাটাগরিতে তিন কাঠার প্লটের আবেদন করে। তাদের আবেদনের সিরিয়াল নাম্বার- ১১৮৪, ১০৫০, ১১৮৩ এবং এম আর নাম্বার- ৩৬২৭৮, ৩৫৬৪২, ৩৬২৭৬।

এছাড়াও কাদিরের ভায়রার ছেলে নাসির সরকারের নামে তিন কাঠা প্লটের আবেদন করে, যার সিরিয়াল নাম্বার- ১০৬৩ এম আর নাম্বার- ৩৫৬৭৭, কাদিরের ভায়রার মেয়ে লূৎফা বেগমের নামেও ওই ক্যাটাগরিতে তিন কাঠার প্লটের আবেদন করে যার সিরিয়াল নাম্বার- ১০৬৪ ও এম আর নাম্বার- ৩৫৬৭৯। এদের কারো জমি বা বসতভিটা পূর্বাচল প্রকল্পে ছিল না।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, কাদির চেয়ারম্যানের আরেক আত্মীয় খাদিজা আক্তার তিশার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে প্লটের আবেদন করেছে, ওই সময় তার জন্মই হয়নি। অথচ তার জমি ও বসতবাড়ি পূর্বাচল প্রকল্পে পড়েছে দেখিয়ে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্লটের আবেদন করেছে যার সিরিয়াল নাম্বার- ১১৮৫ এবং এম আর নাম্বার- ৩৬২৭৯।তার আরেক আত্মীয় রুনা আক্তার, পিতা- আনোয়ার হোসেন, বাড়ি- রূপগঞ্জ উপজেলার শিমুলিয়া গ্রামে তার নামে তিন কাঠার প্লটের আবেদন করেছে যার সিরিয়াল নাম্বার- ১০৮১, এম আর নাম্বার- ৩৬৭০১।

একইভাবে আনোয়ার হোসেন, পিতা- মৃত শাহাজ উদ্দিন, তার বাড়িও রূপগঞ্জ। তার নামে পাঁচ কাঠার প্লটের আবেদন করে, যার সিরিয়াল নাম্বার- ১০৯২ ও এম আর নাম্বার- ৩৫৭১৩। কাদিরের আরেক আত্মীয় রুনিয়া আক্তার, পিতা- আনোয়ার হোসেন, তার নামে ক্ষতিগ্রস্ত কোটায় তিন কাঠার প্লটের আবেদন করেছে, যার সিরিয়াল নাম্বার- ১০৮০ ও এম আর নাম্বার- ৩৫৬৯৯।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ৩০ মে রাজউক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী ইউনিয়নের বড়কাউ ও পাড়াবর্থা মৌজায় অধিগ্রহণকৃত জমির মূল্যে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে তিন ও পাঁচ কাঠা আয়োতনের প্লট বরাদ্দের জন্য রাজউক ভবনস্থ সোনালী/অগ্রনী/জনতা ব্যাংক থেকে অফেরতযোগ্য এক হাজার টাকা মূল্যের আবেদনপত্রের ফর্ম ও প্রসপেক্টাস সংগ্রহ করতে। সেই আলোকে পিডি উজ্জ্বল মল্লিক নাগরী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল কাদিরের সহায়তায় জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এল এ শাখার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে নিকট ও দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের নামে জমির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রায় দুই শতাধিক লোকের নামে ক্ষতিগ্রস্ত প্লটের জন্য আবেদন করে। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, তাদের কারো জমি বা বসত ভিটা পূর্বাচল প্রকল্পের আওতায় নাই।

অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, শুধু ক্ষতিগ্রস্ত প্লটের আবেদন নয়, ওই সব ভুয়া কাগজপত্রের আলোকে একোয়ারকৃত রেটে জমির মূল্য উঠিয়ে নেয়। সূত্র জানায়, উজ্জ্বল মল্লিকের সরাসরি হস্তক্ষেপে ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে জমির মূল্য পরিশোধ করার ব্যবস্থা করে ওই টাকার অর্ধেক উজ্জ্বল মল্লিক নেয়। এই খাত থেকে উজ্জ্বল মল্লিক প্রায় শত কোটি টাকা ভাগ পায়।

ওই সব ভুয়া ক্ষতিগ্রস্তদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দ্রুত তাদের প্লট প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে এবং কয়েক মাসের মধ্যে ওই সব প্লটের সেল পারমিশন বের করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে দেয়। সূত্র জানায়, উজ্জ্বল মল্লিক ওই দুই শত প্লট উচ্চমূল্য বিক্রি করে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা ভাগ পায়।

তৎকালীন পিডি উজ্জ্বল মল্লিক পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের কালীগঞ্জ অংশ থেকে ওই পরিমাণন অনৈতিক আয় করে। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ অংশে অন্যান্য লোকদের যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে জমির দাম ও ক্ষতিগ্রস্ত প্লট বরাদ্দ দিয়ে এবং পরে তা বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা আয় করে।

গোপালগঞ্জের জামাই হিসাবে আওয়ামী লীগের শাসনামলের সতের বছরে প্রচন্ড প্রতাপে রাজউক ভবন টতস্ত রাখেন উজ্জ্বল মল্লিক। পূর্বাচল প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি ঢাকতে উজ্জ্বল মল্লিক শেখ সেলিমকে দিয়ে সিনিয়র পাঁচজনকে টপকিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর মসনদ দখল করেন। শেখ সেলিমের প্রভাব খাটিয়ে রাজউক ভবনে ছোট পদে গোপালগঞ্জের অনেকগুলো কর্মচারী নিয়োগ দিয়ে তাদের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেন। সাথে সাথে গোপালগঞ্জের নামধারী কিছু সাংবাদিক পালতেন।

প্রধান প্রকৌশলীর পদে আশিন হয়ে উজ্জ্বল মল্লিকের অনিয়ম ও দুর্নীতি আরো বেড়ে যায়। পাঁচ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজউকের নতুন চেয়ারম্যান যোগদানের পর উজ্জ্বল মল্লিককে প্রধান প্রকৌশলীর পদ থেকে সরিয়ে ওএসডি করা হয়।

সূত্র জানায়, উজ্জ্বল মল্লিক অনিয়ম ও দুর্নীতির শত শত কোটি টাকা দিয়ে নিজ এলাকা চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বহুতল ভবনের বাড়ি, কক্সবাজারে রিসোর্টসহ কিনেছেন সম্পদের পাহাড়। শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জেও কিনেছেন পঞ্চাশ বিঘা জমি। এখানেই শেষ নয়, হুন্ডির মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের টাকা পাচার করেছেন ভারতে। কলকাতার অভিজাত এলাকা সল্টলেকে তার রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট। টালিগঞ্জেও রয়েছে বাড়ি ও জমি।

সূত্র জানায়, উজ্জ্বল মল্লিকের স্ত্রী একইসাথে বাংলাদেশ ও ভারতের নাগরিক। তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে তদন্ত করলে অবৈধ টাকা লেনদেনের প্রমাণ মিলবে।

তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিকের বক্তব্য নিতে তার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি অভিযোগের বিষয়ে অস্বীকার করেন।