ঢাকা ১১:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫, ২৭ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই মাত্র পাওয়াঃ
পাকিস্তানে যাত্রীবাহী ট্রেনে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা বিএনপিতে কোনো বেয়াদবের জায়গা থাকবে না: হীরা মানুষের কাজ করতে হবে হৃদয় উজার করে: মহসিন মিয়া মধু পাবনা জেল সুপারের মানবিকতায় কারাগার থেকে নিজ দেশে ফিরে গেলেন নেপালী যুবক পাবনায় শিশু ধর্ষণচেষ্টা মামলায় অভিযুক্ত গ্রেপ্তার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন: পিআইও আবুল কালাম আজাদ ও স্ত্রী-ছেলের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা মির্জাপুরে মহানবী (সা.) কে নিয়ে কটূক্তি করায় যুবক গ্রেপ্তার রমজানে ৫০০ জন রোজাদারদের মাঝে ইফতার বিতরণ করছে “মানুষের পাশে আমরা, যশোর” বিজিবির অভিযানে ২০ লাখ টাকার মাদকসহ আটক ১০ বিবেকের জাগরণ: কখন আসবে আমাদের চেতনার আলো? রাজশাহীতে চিকিৎসকদের কর্মবিরতি, দুর্ভোগে রোগীরা বদলগাছীতে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস উদযাপন

বিবেকের জাগরণ: কখন আসবে আমাদের চেতনার আলো?

সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ এর মহাসচিব মীর আব্দুল আলীম

মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসে সমাজ, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের বিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝে ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো- আমাদের বিবেক কি সত্যিই জাগ্রত আছে? নাকি আমরা এক ধরনের নিস্তব্ধতা, অন্ধত্ব ও বধিরতার দিকে ধাবিত হচ্ছি?

প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে ঘটে চলেছে দুর্নীতি, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, খাদ্যে ভেজালসহ নানা অমানবিক কার্যকলাপ। অথচ আমরা যেন নির্বিকার। আমরা এসব ঘটনার প্রতিবাদ করি না, বরং কেবল মেনে নিতে শিখেছি। আমরা যেন নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করছি। এই পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো? আমাদের বিবেক কি সত্যিই নিস্তেজ হয়ে গেছে? কবে আমরা মানবিক হতে পারবো?

বর্তমান সমাজে অন্যায় দেখেও চুপ থাকা, দুঃখের আর্তনাদ শুনেও না শোনা, সমাজের পতন ঘটতে দেখেও চোখ বন্ধ রাখার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেন আমাদের নৈতিকতা লোপ পেয়েছে, আমাদের অনুভূতি পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেছে। একসময় আমরা চিৎকার করতাম, প্রতিবাদ করতাম, রাস্তায় নামতাম। কিন্তু এখন আমরা কেবলই সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ ঝাড়ি, পোস্ট দেই, কমেন্ট করি, তাতেই আমাদের দায়িত্ব শেষ। এটি কি যথেষ্ট?

যখন কোনো শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, যখন কোনো কৃষকের ফসল লুট হয়ে যায়, যখন কোনো মা তার সন্তানকে খাদ্যের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে— তখন আমরা কিছুক্ষণ আবেগপ্রবণ হই, এরপর আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাই। এর অর্থ হলো, আমরা চোখ থাকতেও দেখতে চাই না, কান থাকতেও শুনতে চাই না, মুখ থাকতেও প্রতিবাদ করতে চাই না। ফলে সমাজের অন্ধত্ব, বধিরতা ও নির্বাকতার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

সমাজের অবক্ষয়ের এই চিত্র প্রতিদিন আমাদের সামনে ফুটে উঠলেও আমরা যেন ক্রমেই এতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, হত্যা—এসব এখন আর আমাদের চোখে নতুন কিছু নয়। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই আমরা দেখি, কোনো না কোনো স্থানে এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, কোনো নিরীহ ব্যক্তি খুন হয়েছে, কোনো গরিব কৃষক তার শেষ সম্বলটুকু হারিয়েছে, কিংবা কোনো সৎ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অথচ এসব ঘটনা দেখে আমাদের অনুভূতিগুলো আর আগের মতো আলোড়িত হয় না। আমরা যেন এক নির্লিপ্ত, অনুভূতিহীন জাতিতে পরিণত হয়েছি। অন্যায়কে আমরা চোখের সামনে দেখেও না দেখার ভান করি, প্রতিবাদ তো দূরের কথা, অনেক সময় নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করি।

এই চুপ করে থাকা কি সত্যিই নিরাপদ? না, এটি আসলে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া কিছুই নয়। যখন অপরাধীরা অপরাধ করেও শাস্তির মুখোমুখি হয় না, বরং ক্ষমতার জোরে মুক্ত হয়ে যায়, তখন তাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। সমাজের আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, সৎ ও নিরীহ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে, যারা অপরাধ করছে, তারা আরও নির্ভয়ে, আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এভাবে ধীরে ধীরে অন্যায় সমাজের স্বাভাবিক রূপ ধারণ করে। সাধারণ মানুষ যখন দেখে যে অপরাধীদের বিচার হয় না, তখন তারা ন্যায়বিচারের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। ফলে ধীরে ধীরে সমাজের বিবেক মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। সত্য কথা বলা তখন বিপজ্জনক হয়ে যায়, সৎ মানুষরা নির্যাতিত হয়, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসও ক্রমশ হারিয়ে যায়।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা কেবল সাহসের বিষয় নয়, এটি নৈতিক দায়িত্বও বটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের সমাজে এখন সেই নৈতিক চেতনার অভাব দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতা ও পুঁজির দাপটে ন্যায়বিচার অনেক সময় হারিয়ে যায়। যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে, তারা নানাভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়। ফলে অনেকে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু এই নীরবতা আসলে অন্যায়কারীদের আরও শক্তিশালী করে তোলে। সমাজের সৎ ও সচেতন মানুষ যদি একত্রিত না হয়, যদি ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয় না করে, তাহলে অপরাধ আরও শেকড় গেড়ে বসবে। আর একদিন আমরা এমন এক সমাজে বাস করব, যেখানে সত্য ও ন্যায়ের অস্তিত্ব কেবল গল্প-কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে, নীরবতা ভাঙতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, দুর্নীতি, ধর্ষণ, হত্যা, চাঁদাবাজির মতো ভয়ংকর অপরাধের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে দাঁড়াতে হবে। না হলে, আমরা নিজেরাই একদিন এই অন্যায়ের শিকার হয়ে যাব এবং তখন প্রতিবাদ করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

প্রশ্ন হলো, আমাদের বিবেক কবে জাগবে? আমরা কবে সত্যিকার অর্থে মানবিক হবো? কবে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সমাজের গভীরে যেতে হবে। কারণ আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের মূল শেকড় লুকিয়ে আছে পারিবারিক, শিক্ষা এবং সামাজিক কাঠামোর অভ্যন্তরে। যদি আমরা সত্যিকার অর্থে বিবেক জাগ্রত করতে চাই, তবে আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে সচেতন হতে হবে এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করতে হবে।

বিবেক জাগ্রত করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা। একজন মানুষ ছোটবেলা থেকে যা শেখে, সেটাই তার নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করে। সন্তানদের ছোটবেলা থেকে সৎ, সাহসী ও ন্যায়পরায়ণ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাদের শেখাতে হবে অন্যায় মেনে না নেওয়ার শিক্ষা। সন্তানদের সামনে যদি অভিভাবকেরাই মিথ্যা বলেন, দুর্নীতি করেন বা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন, তবে তারা কীভাবে ন্যায়পরায়ণতা শিখবে? তাই পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় কেবল পুঁথিগত জ্ঞান নয়, নৈতিকতা ও সততার শিক্ষা যুক্ত করতে হবে। নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি সমাজে অন্যায় ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটায়। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ—এই তিনটি স্তরে যদি নৈতিকতার চর্চা হয়, তবে ধীরে ধীরে সমাজে পরিবর্তন আসতে পারে।

অপরাধের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে। বর্তমানে অনেক অপরাধীর বিচার হয় না। কারণ তারা রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় থাকে। এ ধরনের সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হলে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ করলে রেহাই নেই—এই বার্তাটি শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অপরাধীরা যদি জানে যে তারা ক্ষমতার জোরে ছাড় পেয়ে যাবে, তবে তারা অপরাধ করতেই থাকবে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রেখে নিরপেক্ষ ও কঠোর হতে হবে।

আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। যেমন অতীতে নাটক ও সাহিত্য সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল, তেমনভাবে এখনো তা করা সম্ভব। আমরা যদি সমাজের অন্যায়, দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজগুলোর বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি, তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে। অতীতে অনেক নাটক, গান ও চলচ্চিত্র সমাজের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এসবের অভাব দেখা যাচ্ছে। তাই সাংস্কৃতিক মাধ্যমকে শক্তিশালী করতে হবে এবং সমাজ পরিবর্তনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মিডিয়াকে অবশ্যই সত্য প্রকাশে সাহসী হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো যেতে পারে। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে। আমরা যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াই, প্রতিবাদ করি, তখনই সমাজে পরিবর্তন আসবে। একজন মানুষ প্রতিবাদ করলে হয়তো কেউ শুনবে না, কিন্তু একশো, এক হাজার বা লক্ষ মানুষ যদি প্রতিবাদ করে, তাহলে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমাজ পরিবর্তন কোনো একক ব্যক্তির কাজ নয়, বরং এটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। যদি প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, সৎ ও ন্যায়ের পথে চলে, তবে ধীরে ধীরে সমাজে সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে। আমাদের বিবেক তখনই সত্যিকার অর্থে জাগবে, যখন আমরা কেবল নিজেদের স্বার্থের কথা ভাববো না, বরং সমাজের জন্য কিছু করার মানসিকতা তৈরি করবো। আমাদের দায়িত্ব হলো নিজেদের জীবনকে সৎ ও নৈতিকতার পথে পরিচালিত করা, অন্যদের অনুপ্রাণিত করা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। তাহলেই আমরা সত্যিকার অর্থে মানবিক হতে পারবো এবং আমাদের সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবো।

উপসংহার:

মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সভ্যতার দিকে ধাবিত হয়েছে, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে শিখেছে এবং সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তুলেছে। কিন্তু আজকের সমাজে সেই মূল্যবোধ কতটুকু অবশিষ্ট আছে? আমরা কি সত্যিই ন্যায়পরায়ণ সমাজ গড়তে পেরেছি, নাকি ক্রমেই অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছি?

আমাদের বিবেক কি সত্যিই মরে গেছে? নাকি আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বন্ধ করে রেখেছি? আমাদের উচিত নিজের অন্তরকে প্রশ্ন করা, আমরা কি সত্যিই সভ্য? আমরা কি সত্যিকার অর্থে মানুষ? যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা খুঁজতে পারি, তাহলে আমাদের বিবেকও জাগ্রত হবে। সমাজ বদলাতে হলে প্রথম পরিবর্তনটা নিজেকেই আনতে হবে। আজ যদি আমরা অন্ধ, বধির ও নির্বাক হয়ে থাকি, তবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাব? সময় এসেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, সময় এসেছে বিবেককে জাগ্রত করার। সমাজ তখনই শান্ত হবে, যখন আমরা সত্যিকার অর্থে ন্যায়পরায়ণ হবো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো। বিবেক জাগ্রত হোক, সমাজ পরিবর্তিত হোক, মানুষ সত্যিকার অর্থে মানুষ হোক—এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

পাকিস্তানে যাত্রীবাহী ট্রেনে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা

Verified by MonsterInsights

বিবেকের জাগরণ: কখন আসবে আমাদের চেতনার আলো?

আপডেট সময় ১০:০২:৪৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১১ মার্চ ২০২৫

মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের ইতিহাসে সমাজ, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের বিবর্তন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝে ন্যায়পরায়ণ সমাজ গঠনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো- আমাদের বিবেক কি সত্যিই জাগ্রত আছে? নাকি আমরা এক ধরনের নিস্তব্ধতা, অন্ধত্ব ও বধিরতার দিকে ধাবিত হচ্ছি?

প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশে ঘটে চলেছে দুর্নীতি, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, খাদ্যে ভেজালসহ নানা অমানবিক কার্যকলাপ। অথচ আমরা যেন নির্বিকার। আমরা এসব ঘটনার প্রতিবাদ করি না, বরং কেবল মেনে নিতে শিখেছি। আমরা যেন নির্বাক দর্শকের ভূমিকা পালন করছি। এই পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি হলো? আমাদের বিবেক কি সত্যিই নিস্তেজ হয়ে গেছে? কবে আমরা মানবিক হতে পারবো?

বর্তমান সমাজে অন্যায় দেখেও চুপ থাকা, দুঃখের আর্তনাদ শুনেও না শোনা, সমাজের পতন ঘটতে দেখেও চোখ বন্ধ রাখার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেন আমাদের নৈতিকতা লোপ পেয়েছে, আমাদের অনুভূতি পাথরের মতো কঠিন হয়ে গেছে। একসময় আমরা চিৎকার করতাম, প্রতিবাদ করতাম, রাস্তায় নামতাম। কিন্তু এখন আমরা কেবলই সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ ঝাড়ি, পোস্ট দেই, কমেন্ট করি, তাতেই আমাদের দায়িত্ব শেষ। এটি কি যথেষ্ট?

যখন কোনো শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, যখন কোনো কৃষকের ফসল লুট হয়ে যায়, যখন কোনো মা তার সন্তানকে খাদ্যের অভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখে— তখন আমরা কিছুক্ষণ আবেগপ্রবণ হই, এরপর আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাই। এর অর্থ হলো, আমরা চোখ থাকতেও দেখতে চাই না, কান থাকতেও শুনতে চাই না, মুখ থাকতেও প্রতিবাদ করতে চাই না। ফলে সমাজের অন্ধত্ব, বধিরতা ও নির্বাকতার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।

সমাজের অবক্ষয়ের এই চিত্র প্রতিদিন আমাদের সামনে ফুটে উঠলেও আমরা যেন ক্রমেই এতে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি। ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দুর্নীতি, হত্যা—এসব এখন আর আমাদের চোখে নতুন কিছু নয়। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই আমরা দেখি, কোনো না কোনো স্থানে এক নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে, কোনো নিরীহ ব্যক্তি খুন হয়েছে, কোনো গরিব কৃষক তার শেষ সম্বলটুকু হারিয়েছে, কিংবা কোনো সৎ ও ন্যায়পরায়ণ মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অথচ এসব ঘটনা দেখে আমাদের অনুভূতিগুলো আর আগের মতো আলোড়িত হয় না। আমরা যেন এক নির্লিপ্ত, অনুভূতিহীন জাতিতে পরিণত হয়েছি। অন্যায়কে আমরা চোখের সামনে দেখেও না দেখার ভান করি, প্রতিবাদ তো দূরের কথা, অনেক সময় নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করি।

এই চুপ করে থাকা কি সত্যিই নিরাপদ? না, এটি আসলে অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া ছাড়া কিছুই নয়। যখন অপরাধীরা অপরাধ করেও শাস্তির মুখোমুখি হয় না, বরং ক্ষমতার জোরে মুক্ত হয়ে যায়, তখন তাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। সমাজের আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, সৎ ও নিরীহ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে, যারা অপরাধ করছে, তারা আরও নির্ভয়ে, আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। এভাবে ধীরে ধীরে অন্যায় সমাজের স্বাভাবিক রূপ ধারণ করে। সাধারণ মানুষ যখন দেখে যে অপরাধীদের বিচার হয় না, তখন তারা ন্যায়বিচারের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। ফলে ধীরে ধীরে সমাজের বিবেক মৃতপ্রায় হয়ে পড়ে। সত্য কথা বলা তখন বিপজ্জনক হয়ে যায়, সৎ মানুষরা নির্যাতিত হয়, আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসও ক্রমশ হারিয়ে যায়।

অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা কেবল সাহসের বিষয় নয়, এটি নৈতিক দায়িত্বও বটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমাদের সমাজে এখন সেই নৈতিক চেতনার অভাব দেখা যাচ্ছে। ক্ষমতা ও পুঁজির দাপটে ন্যায়বিচার অনেক সময় হারিয়ে যায়। যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে, তারা নানাভাবে হুমকির সম্মুখীন হয়। ফলে অনেকে নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রতিবাদ করা থেকে বিরত থাকে। কিন্তু এই নীরবতা আসলে অন্যায়কারীদের আরও শক্তিশালী করে তোলে। সমাজের সৎ ও সচেতন মানুষ যদি একত্রিত না হয়, যদি ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর শক্তি সঞ্চয় না করে, তাহলে অপরাধ আরও শেকড় গেড়ে বসবে। আর একদিন আমরা এমন এক সমাজে বাস করব, যেখানে সত্য ও ন্যায়ের অস্তিত্ব কেবল গল্প-কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

আমাদের এখনই সচেতন হতে হবে, নীরবতা ভাঙতে হবে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে, দুর্নীতি, ধর্ষণ, হত্যা, চাঁদাবাজির মতো ভয়ংকর অপরাধের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে দাঁড়াতে হবে। না হলে, আমরা নিজেরাই একদিন এই অন্যায়ের শিকার হয়ে যাব এবং তখন প্রতিবাদ করার আর কোনো সুযোগ থাকবে না।

প্রশ্ন হলো, আমাদের বিবেক কবে জাগবে? আমরা কবে সত্যিকার অর্থে মানবিক হবো? কবে আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াবো? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের সমাজের গভীরে যেতে হবে। কারণ আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের মূল শেকড় লুকিয়ে আছে পারিবারিক, শিক্ষা এবং সামাজিক কাঠামোর অভ্যন্তরে। যদি আমরা সত্যিকার অর্থে বিবেক জাগ্রত করতে চাই, তবে আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে সচেতন হতে হবে এবং ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করতে হবে।

বিবেক জাগ্রত করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা। একজন মানুষ ছোটবেলা থেকে যা শেখে, সেটাই তার নৈতিকতার ভিত্তি তৈরি করে। সন্তানদের ছোটবেলা থেকে সৎ, সাহসী ও ন্যায়পরায়ণ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাদের শেখাতে হবে অন্যায় মেনে না নেওয়ার শিক্ষা। সন্তানদের সামনে যদি অভিভাবকেরাই মিথ্যা বলেন, দুর্নীতি করেন বা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন, তবে তারা কীভাবে ন্যায়পরায়ণতা শিখবে? তাই পরিবার থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নৈতিকতার চর্চা করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় কেবল পুঁথিগত জ্ঞান নয়, নৈতিকতা ও সততার শিক্ষা যুক্ত করতে হবে। নৈতিক শিক্ষার অনুপস্থিতি সমাজে অন্যায় ও দুর্নীতির বিস্তার ঘটায়। পরিবার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমাজ—এই তিনটি স্তরে যদি নৈতিকতার চর্চা হয়, তবে ধীরে ধীরে সমাজে পরিবর্তন আসতে পারে।

অপরাধের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর হতে হবে। যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে, তাদের কঠিন শাস্তি দিতে হবে। বর্তমানে অনেক অপরাধীর বিচার হয় না। কারণ তারা রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ছত্রছায়ায় থাকে। এ ধরনের সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হলে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধ করলে রেহাই নেই—এই বার্তাটি শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অপরাধীরা যদি জানে যে তারা ক্ষমতার জোরে ছাড় পেয়ে যাবে, তবে তারা অপরাধ করতেই থাকবে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রেখে নিরপেক্ষ ও কঠোর হতে হবে।

আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতনতা সৃষ্টি করা যেতে পারে। যেমন অতীতে নাটক ও সাহিত্য সমাজ বদলের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিল, তেমনভাবে এখনো তা করা সম্ভব। আমরা যদি সমাজের অন্যায়, দুর্নীতি ও অনৈতিক কাজগুলোর বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারি, তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হবে। অতীতে অনেক নাটক, গান ও চলচ্চিত্র সমাজের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এসবের অভাব দেখা যাচ্ছে। তাই সাংস্কৃতিক মাধ্যমকে শক্তিশালী করতে হবে এবং সমাজ পরিবর্তনের কাজে ব্যবহার করতে হবে। এছাড়াও গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মিডিয়াকে অবশ্যই সত্য প্রকাশে সাহসী হতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের শক্তিকে ইতিবাচকভাবে কাজে লাগিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো যেতে পারে। সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে সচেতন হতে হবে। আমরা যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াই, প্রতিবাদ করি, তখনই সমাজে পরিবর্তন আসবে। একজন মানুষ প্রতিবাদ করলে হয়তো কেউ শুনবে না, কিন্তু একশো, এক হাজার বা লক্ষ মানুষ যদি প্রতিবাদ করে, তাহলে অবশ্যই পরিবর্তন আসবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, সমাজ পরিবর্তন কোনো একক ব্যক্তির কাজ নয়, বরং এটি সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। যদি প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, সৎ ও ন্যায়ের পথে চলে, তবে ধীরে ধীরে সমাজে সুস্থ পরিবেশ ফিরে আসবে। আমাদের বিবেক তখনই সত্যিকার অর্থে জাগবে, যখন আমরা কেবল নিজেদের স্বার্থের কথা ভাববো না, বরং সমাজের জন্য কিছু করার মানসিকতা তৈরি করবো। আমাদের দায়িত্ব হলো নিজেদের জীবনকে সৎ ও নৈতিকতার পথে পরিচালিত করা, অন্যদের অনুপ্রাণিত করা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। তাহলেই আমরা সত্যিকার অর্থে মানবিক হতে পারবো এবং আমাদের সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারবো।

উপসংহার:

মানুষ সৃষ্টির আদিকাল থেকেই সভ্যতার দিকে ধাবিত হয়েছে, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝতে শিখেছে এবং সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তুলেছে। কিন্তু আজকের সমাজে সেই মূল্যবোধ কতটুকু অবশিষ্ট আছে? আমরা কি সত্যিই ন্যায়পরায়ণ সমাজ গড়তে পেরেছি, নাকি ক্রমেই অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছি?

আমাদের বিবেক কি সত্যিই মরে গেছে? নাকি আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে চোখ বন্ধ করে রেখেছি? আমাদের উচিত নিজের অন্তরকে প্রশ্ন করা, আমরা কি সত্যিই সভ্য? আমরা কি সত্যিকার অর্থে মানুষ? যদি এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আমরা খুঁজতে পারি, তাহলে আমাদের বিবেকও জাগ্রত হবে। সমাজ বদলাতে হলে প্রথম পরিবর্তনটা নিজেকেই আনতে হবে। আজ যদি আমরা অন্ধ, বধির ও নির্বাক হয়ে থাকি, তবে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কী রেখে যাব? সময় এসেছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর, সময় এসেছে বিবেককে জাগ্রত করার। সমাজ তখনই শান্ত হবে, যখন আমরা সত্যিকার অর্থে ন্যায়পরায়ণ হবো, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবো। বিবেক জাগ্রত হোক, সমাজ পরিবর্তিত হোক, মানুষ সত্যিকার অর্থে মানুষ হোক—এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক- মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।