ঢাকার সিএমএম আদালতে দলীয় পরিচয়, নাম-ডাকহীন একজন উকিল মোরশেদ হোসেন শাহীন এখন পরিচিতি আসামি পক্ষের আইনজীবী হিসেবে। ৫ই আগস্ট পরবর্তী আটক আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ অনেকের পক্ষে যখন আদালতে কেউ ছিলেন না তখন আসামিদের পক্ষের আইনজীবী হিসেবে আবির্ভূত হন মোরশেদ হোসেন শাহীন।
সম্প্রতি আদালত চত্তরে সায়েদুল হক সুমনকে (ব্যারিস্টার সুমন হিসেবে পরিচিত) হাজির করার পর শুনানী শেষে মিডিয়ায় ব্রিফ করার সময় মারধরের শিকার হন তিনি। বর্তমান পরিস্থিতিতে নিরাপত্তাহীনতার অভিযোগও করলেন মোরশেদ হোসেন।
“তাদের প্রায় ৫৭ জনের আইনজীবী হিসেবে যেহেতু লড়াই করতেছি যে কারণে আপনারা মিডিয়ার মাধ্যমে দেখেছেন আমাকে হামলাও করা হয়েছে। বিভিন্ন হুমকিও দেয়া হচ্ছে। সেই হিসেবে আমি মনে করি নিরাপত্তাহীনতায় আছি।”
বর্তমানে আওয়ামীপন্থী আইনজীবীদের খুব নগন্য সংখ্যক কোর্টে আসছেন। দলীয় পরিচয় এবং বিগত ১৫ বছরে তাদের ভূমিকার পর ৫ই আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতে অনেকেই আদালতমুখী হচ্ছেন না। আওয়ামীপন্থী বা দলটির সমর্থক আইনজীবীদের কথায় আসামী পক্ষের মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হুমকির এবং আতঙ্কের পরিবেশ বিরাজ করছে।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আইনজীবী কুমার দেবুল দে আওয়ামী লীগ প্যানেল থেকে নির্বাচন করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিকে আওয়ামী লীগ ঘরানার আইনজীবীদের জন্য মারাত্মক প্রতিকূল হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।
“আমাদের অনেক বন্ধুরাই এরেস্ট হয়েছে। অনেক বন্ধুরা আসামীকে রিপ্রেজেন্ট করতে গিয়ে মাইর খাইছে। ভীতিতো সবসময়ই আছে। যেকোনো কিছুই হতে পারে। আপনার সঙ্গে কথা বলেছি দেখা গেল আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাইতে পারে। এটার ইমপ্লিকেশন হচ্ছে আপনার মানুষের মনে একটা পারসেপশন তৈরি হবে যে দেশে আইন নাই, আদালত নাই, বিচার পাওয়া যাবে না,” বলছিলেন কুমার দেবুল দে।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী আদালত প্রাঙ্গনে আসামীদের উপর হামলা আক্রমণের ঘটনা থামলেও সার্বিকভাবে আদালতের পরিবেশ এখনো সন্তোষজনক নয় বলে মনে করছেন আইনজীবীদের অনেকে।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আদালত বিচারব্যবস্থা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে উত্তরণের যাত্রায় বর্তমান পরিস্থিতিকেও অনাকাঙ্খিত বলেও সমালোচনা হচ্ছে।
গত আড়াই মাসে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া মাত্র দুজন সাবেক মন্ত্রী জামিনে মুক্ত হয়েছেন। তাদের মধ্যে সাবের হোসেন চৌধুরীর পক্ষের আইনজীবী ছিলেন এহসানুল হক সমাজী। আইনজীবীর উপর হামলার ঘটনা উল্লেখ করে এহসানুল হক সমাজী বলেন ৩৮ বছরের আইন পেশার জীবনে তিনি এমন ঘটনা দেখেননি।
“আমি ব্যক্তিগতভাবে যাকে আমি রিপ্রেজেন্ট করেছি, আমার সাথে কেউ অসদাচারণ করেনি। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তির সাথে পুলিশ প্রহরাধীন থাকা অবস্থায় তার প্রতি অসম্মানজনক বক্তব্য দিয়েছেন। কে বা কারা দিয়েছেন সেটা আমি বলতে পারবো না। তবে সেটা পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যে থাকা অবস্থায়। সেটার আমি নিন্দা জানাই,” বলেন এহসানুল হক সমাজী। তিনি বলেন, সম্প্রতি আসামীদের সঙ্গে আদালত প্রাঙ্গনে যেটা ঘটেছে সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত, দুঃখজনক এবং নিন্দনীয়।
আদালত প্রাঙ্গণে যারা আসবেন – বাদী, বিবাদী কিংবা সাক্ষী – কেউ যাতে হয়রানীর শিকার না হয় এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আইনজীবীদের রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক না কেন সবার মধ্যে ঐক্য থাকা জরুরী বলে মনে করেন এহসানুল হক সমাজী।
আদালতে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে এহসানুল হক সমাজী বলেন, “আমি বারে যখন আসবো আমি আশা করবো আমার সঙ্গে বারের সদস্যদের সবার দেখা হবে কুশলাদি বিনিময় হবে সে যে কোনো দলেরই হোক সেটা কোনো প্রশ্ন না। কিন্তু এখনতো অনেককে দেখতে পাচ্ছি না।”
শুরুর দিকে আদালত চত্তরে আসামীদের হাজির করা হলেই ডিম নিক্ষেপ, হামলা আক্রমণের ঘটনায় সমালোচনা হয়। বিরূপ পরিস্থিতি এড়াতে আদালত প্রাঙ্গনে হাইপ্রোফাইল আসামি হাজির করার সময় নিরাপত্তা বাড়ানো এবং নানা কৌশল অবলম্বন করে আসামী হাজির করা হচ্ছে।
গত দেড় মাস ধরে হাইপ্রোফাইল আসামীদের ভোর বেলায় হাজির করতে দেখা গেছে। এতে করে প্রথম দিকে যেভাবে হামলা আক্রমণ হয়েছে সেটি অনেকটাই কমেছে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে বলে দাবি করেন ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী।
“১৫ বছর যারা ফ্যাসিস্ট ছিল ওদের পক্ষে যে কেউ দাঁড়াবে প্রথম প্রথম তারা কেউ সাহস নিয়ে আসে নাই। এখন তাদের আইনজীবীরা ওকালতনামা দিচ্ছে, শুনানী করছে। এবং সবাই আইনের সহায়তা পাচ্ছে। শুনানী শেষে নিচে এসে তারা ব্রিফিং দিচ্ছে। আদালতের ভিতরেও আদালত আইনজীবীদের কথা শুনছেন, আসামীর কথাও শুনছেন,” বলেন ওমর ফারুক ফারুকী।
“কোনো ধরনের সমস্যা নাই এখন। ৫ই আগস্টের পর একটা অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছিল বিভিন্ন যায়গায় পনেরো বছরে মানুষের ক্ষোভের কারণে। এখন আদালত অঙ্গন পুরোপুরি শান্ত। আমি মনে করি পরিবেশ হান্ড্রেড পার্সেন্ট উন্নতি হয়েছে।”
নবনিযুক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর এবং জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতা ওমর ফারুক ফারুকী পরিস্থিতি স্বাভাবিক দাবি করলেও সিনিয়র আইনজীবীদের কাছে বাস্তবতা ভিন্ন। আদালতে আওয়ামী লীগের নেতাদের পক্ষে সিনিয়র আইনজীবীদের অনুপস্থিতি এবং আদালতে আইনজীবীর উপর হামলার ঘটনা উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আদালতে বিচারকদের রায় প্রদানের ক্ষেত্রে চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। অতীতের অনেক স্পর্ষকাতর মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার ক্ষেত্রে যেমন চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে তেমনি হত্যা মামলা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকার পরেও রিমান্ড মঞ্জুর করতে আইনজীবীরা প্রভাব বিস্তার করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম বলেন, প্রথম প্রথম কোর্টের ভিতর যত হট্টগোল হয়েছিল আস্তে আস্তে কিছুটা হলেও সেগুলো কমে আসছে। উদ্বেগজনক যেটা হচ্ছে যখন আসামি নিয়ে কোর্টের ভেতর ঢোকা হচ্ছে সেখানে আইনজীবীর পরিচয় কোর্ট ইত্যাদি পরে নকল আইনজীবীরাও সেখানে সমাগম করছে। এটাকে প্রতিরোধ করা দরকার।
এছাড়া আইনজীবীর ওপর হামলার প্রসঙ্গ টেনে আহসানুল করিম বলেন, একাধিক দিক থেকে বিচ্যুতি হচ্ছে আইন ভঙ্গ হচ্ছে। “কদিন আগে দেখলাম একজন আইনজীবী ছোটো-খাট একজন আইনজীবী তাকে মারধর করা হচ্ছে সেটা অনভিপ্রেত। এর ইমপ্লিকেশন খুবই খারাপ, দেখেন এগুলোতো আজকাল ডিজিটাল যুগে সারা পৃথিবীতে এই ধরনের দৃশ্যগুলো যাচ্ছে। সভ্য দেশের সভ্য মানুষ এগুলোকে পছন্দ করেন না। আইন কানুন, সামাজিক প্রেক্ষাপট সামাজিক নর্মস নৈতিকতা সবকিছু মিলিয়ে আমি মনে করি যে কোর্ট কাচারিতে যে ঘটনাগুলি ঘটছে সেইটা খুব শিগগিরই বন্ধ হওয়া প্রয়োজন,” বলেন আহসানুল করিম।
“যেকোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে যে কোনও সময় এই ঘটনা ঘটতে পারে। এবং যে ঘটনাগুলো একবার যখন ঘটে তখন আমাদের মতো দেশে এগুলো কন্টিনিউয়াসলি চলতে থাকে এবং সহজে এগুলো শেষ হয় না। সুতরাং এগুলো যদি শক্তহাতে দমন না করা হয় তবে এটা কন্টিনিউয়াসলি চলতে থাকবে,” বলেন আহসানুল করিম।
তিনি বলেন, এসব ঘটনা থামানোর জন্য এখন প্রয়োজন দরকার হলে অর্ডিন্যান্স জারি করা, নোটিফিকেশন জার করা, সুপ্রিম কোর্ট থেকে নির্দেশনা যাওয়া আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে, বিভিন্ন বারে প্রেসিডেন্টের নির্দেশনা চাওয়া যাতে এই ধরনের ঘটনাগুলি যেন না হয়।
বিগত আওয়ামী লীগ আমলে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি, বিচার ব্যবস্থার অসঙ্গতি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগ ছিল। ৫ই আগস্ট পরবর্তী আওয়ামী লীগের নেতারাও যেভাবে মামলার শিকার হচ্ছেন এবং আদালতে আসামী হিসেবে যেভাবে হামলা আক্রমণের শিকার হয়েছেন সেগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল বলেই বিবেচনা হচ্ছে।
এছাড়া ৫ই আগস্টের পর রুজু হত্যা মামলার যেভাবে গণ আসামী করা হয়েছে সেটি নিয়ে সমালোচনা হয়েছে। হত্যা মামলায় শত শত আসামীর মধ্যে থাকায় অনেকে ঘরছাড়া হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
৫ই আগস্টের পর বিভিন্ন মামলায় আসামীরা আগাম জামিন আবেদন করলেও সেগুলো আমলে নেয়া হচ্ছে না। উচ্চ আদালতের একটি বেঞ্চে আবেদন গ্রহণ করেছে কিন্তু বৃহস্পতিবার পর্যন্ত শুনানির জন্য একটি আবেদনও কার্যতালিকায় আসেনি বলে জানা যায়।
জুলাই আগস্ট হত্যাকাণ্ডে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার বিষয়ে সবাই সোচ্চার। তবে এসব মামলা দিয়ে কেউ যেন হয়রাণির শিকার না হয় এবং যথাযথ তদন্ত করে দোষীদের বিচার করা হয় সেটি নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে সবাই মনে করেন। হত্যার বিচারের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ ব্যাপারে তাগিদ এসেছে জাতিসংঘের তরফেও।
দু’দিনের সফর শেষে ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেছেন, অতীতে যা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না জাতিসংঘ।
“ফৌজদারি অপরাধের বিচার নিশ্চিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ। তবে অভিযোগগুলোর বেলায় যেন তাড়াহুড়ো করা না হয়। এবং আইসিটিসহ সবখানে যেন যথাযথ প্রক্রিয়া ও সুষ্ঠু বিচারের মান বজায় রাখা হয়,” বলেন ভলকার তুর্ক।
সূত্র: বিবিসি