বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলেনর সময় ছাত্রলীগ ও পুলিশ ব্যবহার করে শিক্ষার্থী নির্যাতন, অব্যাহত নিয়োগ দুর্নীতি করে কাড়িকাড়ি টাকা হাতানোসহ নানা অভিযোগ উঠেছে যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ভিসির একান্ত সচিব সহকারি পরিচালক আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে।
আব্দুর রশিদ তার অনুগত শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের দিয়েও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ব্যাপকভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন চালান। সাবেক উপাচার্যের পেটুয়া বাহিনী হিসেবে তার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ছিল বলে অভিযোগে প্রকাশ। এসব অভিযোগের বিষদ বর্ণনা ও প্রমাণ উপস্থাপন করে ২২ অক্টোবর ভুক্তভোগী বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা রেজিস্টারের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করেছে। একই সাথে প্রতারণায় লিপ্ত ও নিয়োগ দুর্নীতি মামলার আসামি হওয়া বহুদোষে দুষ্ট এই আব্দুর রশিদকে অপসারণের করার দাবি জানানো হয়েছে স্মারকলিপিতে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়নরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের দেয়া স্মারকলিপি থেকে তথ্য মিলেছে, গত জুলাই আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের আন্দোলনে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়নরত সাধারণ শিক্ষার্থীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। এই আন্দোলনের শুরু থেকেই সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন চরম বিরোধীতা করে আসছিলেন। এই আন্দোলনকে দমন করার জন্য তিনি ছাত্রলীগ, পুলিশ, তার অনুগত শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের দিয়ে আমাদের ব্যাপকভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন করে। এই ব্যাপারে উপাচার্যের পেটুয়া বাহিনী হিসেবে কাজ করছিলেন তার একান্ত সচিব আব্দুর রশিদ। এই আব্দুর রশিদ অর্ণব বিগত সরকারের মিডিয়া জগৎ নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে পরিচিত ছিল।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপ প্রেস সচিব আশরাফুল ইসলাম খোকনের সুপারিশে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। এই ক্ষমতাবলে আব্দুর রশিদ অর্ণব সাবেক উপাচার্য ড. আনোয়ার হোসেনের ডান হাত খ্যাত হয়ে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিকে পরিণত হন। এছাড়াও ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেনের বন্ধু ছিলেন এই আব্দুর রশিদ অর্ণব। এই দুই ক্ষমতাবলে আব্দুর রশিদ অর্ণব ধরাকে শরা জ্ঞান করতেন।
তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রী আব্দুর রশিদেও নির্যাতনের শিকার হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের ছাত্রলীগের ক্যাডার বন্ধু জাকিরের ক্ষমতার দাপট প্রদর্শন করতেন। এই রশিদের নির্দেশে ছাত্রলীগের ক্যাডার বাহিনী অস্ত্র, রামদা ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে জীবননাশের হুমকি দিয়ে যবিপ্রবির শহীদ মসিয়ূর রহমান হল থেকে ছাত্রদের বের করে দেয়।
এই ঘটনায় অনেক শিক্ষার্থী আহত হন। এই ঘটনার পর যশোরের সাবেক পুলিশ সুপারকে দিয়ে ভিসির পিএস আব্দুর রশিদ ক্যাম্পাসে পুলিশ নিয়ে আসেন এবং পেটুয়া পুলিশ বাহিনী দিয়ে ছাত্রদের ব্যাপক নির্যাতন করেন। ছাত্রদের সেই দিন হল থেকে বের করে দেয়ার পরে মসজিদে নামাজ পর্যন্ত পড়তে দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে ৫ আগস্ট সরকারের পদত্যাগের পর বেশ কিছুদিন আব্দুর রশিদ কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন।
গত ১৩ আগস্ট থেকে সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেনসহ উপাচার্যের দোসর ও দালালদের পদত্যাগের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেন। ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে আব্দুর রশিদ ২০ আগস্ট উপাচার্যের একান্ত সচিব পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেন ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ২১ আগস্ট পদত্যাগ করেন। গত ৯ সেপ্টেম্বর আব্দুর রশিদকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অবাঞ্চিত করে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করেন শিক্ষার্থীরা। আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে একাধিক নিয়োগ বাণিজ্যসহ বেশ কয়েকটি মামলাও রয়েছে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএ পদেও ৬ টি শূণ্য পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা হয়। ওই পদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ২০১৮ সালের ৩০ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়। ওই পরীক্ষায় আবেদন করেন ৩৫৫ জন, কার্ড পান ২৩০ জন, লিখিত পরীক্ষা উপস্থিত হন ১৬০ জন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন ২৩ জন। ওই নিয়োগ পরীক্ষায় আব্দুর রশিদ অর্ণব তার বাল্যবন্ধু বানিয়ালী মনজুরুর রহমানের কাছ থেকে ১৭ লাখ টাকা নিয়ে চাকরি প্রদানের মধ্যস্থতা করেন। গত ১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত রিজেন্ট বোর্ডের ৫০ তম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই নিয়োগ গৃহীত হয়। পরবর্তীতে এই ঘটনা ধরা পড়লে ৫১ তম রিজেন্ট বোর্ডে উক্ত পিএ পদের মুঞ্জর রহমানের চাকরি স্থগিত করেছে।
এই ঘটনায় রিজেন্ট বোর্ডের সদস্য প্রফেসর ডাক্তার আব্দুর রশিদ অপরাধী আখ্যা দিয়ে ভিসির একান্ত সচিব আব্দুর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয় ব্যক্ত করেন। আর টাকা কিংবা চাকরি ফেরত না পেয়ে ২০২০ সালের ২৩ জুন যশোর প্রেসক্লাবে আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে ১৭ লক্ষ টাকার দুর্নীতির অভিযোগে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করা হয়। বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হলে রিজেন্ট বোর্ড থেকে ৩ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ঘটনা তদন্ত শেষে উপাচার্য প্রফেসর ড. আনোয়ার হোসেনের যোগসাজসে তদন্ত প্রতিবেদন আব্দুর রশিদের পক্ষে প্রদান করা হয়।
এই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ন্যায় বিচার না পেয়ে জনাব মনজুরুর রহমান ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি হাইকোর্টে চাকরি ফেরত চেয়ে রিট পিটিশন দাখিল করেন। পিটিশনে রায়ে বিবাদী করা হয়, রিজেন্ট বোর্ডেও সকল সদস্য, উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারকে। রায়ে বিশ্ববিদ্যালয়কর্তৃপক্ষকে একটি শূণ্য পদ রাখার নির্দেশনা প্রদান করেন। মামলাটি হাইকোর্টে এখনও বিচারাধীন।
২০১৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সরস্বতীপুজার অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানের একটি মুহূর্তের ছবি আব্দুর রশিদ ফেসবুকে আপলোড করেন। আপলোড করার পর বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীগণ আব্দুর রশিদের বিচারের দাবি করেন।
এ ঘটনায় লিখিত অভিযোগ করা হলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর ড. শরীফ এনামুল কবিরের নেতৃত্বে রিজেন্ট বোর্ড থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
তদন্ত কমিটি তাকে দোষী সাব্যস্ত করে রিজেন্ট বোর্ড থেকে আব্দুর রশিদ অর্ণবকে সতর্ক করে একটি পত্র প্রেরণ করা হয়। এই ঘটনার সঠিক বিচার না হওয়ায় এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীগণ মাঝে ক্ষোভ রয়ে গেছে।
২০২৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ড্রাইভার মফিজুর রহমানকে নিজের ইচ্ছামত ব্যবহার করেছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া অফিস আদেশ প্রেরণ করা হয়। তার ড্রাইভার পদ বাতিল করে অফিস পিয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। এই ঘটনায় সে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন তিনি। এই ঘটনার ন্যায় বিচার চেয়ে উপার্চাযের অফিসে প্রশাসনিক ভবনের পাঁচতলায় যান মফিজুর।
সেখানে দায়িত্বরত উপাচাযের একান্ত সচিব রশিদ অর্ণব তাকে অফিস থেকে বের করে দেন এবং বলেন পরিবহন প্রশাসক ড. জাফিরুল স্যারের নির্দেশনা অনুযায়ী পিয়নের চাকরি করতে হবে। আর চাকরি না করলে মাঠে কাজ কর গিয়ে। এই ঘটনায় অমানিত ড্রাইভার মফিজুর রহমান মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে ওই রাতেই গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনায় আব্দুর রশিদ অর্ণব সহ অপরাধীদের বিচারের দাবীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা, কর্মচারি ও এলাকাবাসী লাশ নিয়ে মিছিল করেন এবং দায়ীদের দ্রুত শাস্তির দাবি জানান।
এছাড়া, এ ঘটনায় গত ৯ জানুয়ারি বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোতোয়ালি আমলী আদালত সিনিয়র ড্রাইভার মফিজুর রহমানের স্ত্রী জিনিয়া মেহের আব্দুর রশিদ অর্ণবের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি বিচারাধীন। এছাড়া আব্দুর রশিদ অর্ণবের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অফিসার সমিতির সাধারণ সম্পাদক টেকনিক্যাল অফিসার হেলালুল ইসলামের ব্যক্তিগত ফাইল থেকে গোপন নথি বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় কয়েকটি পত্রিকার সাংবাদিকদের গোপনে প্রেরণ করেন।
এই ঘটনার জানাজানি হয়ে গেলে তথ্য প্রমানসহ হেলালুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে আব্দুর রশিদ অর্ণবের বিরুদ্ধে বিচার চেয়ে লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে রিজেট বোডির প্রভাবশালী সদস্য ড. মেহেদী হাসান, সহযোগী অধ্যাপক মার্কেটিং বিভাগকে আহ্বায়ক ও উপ-গ্রন্থকারীক মেহেদী হাসানকে সদস্য-সচিব করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পান এবং আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। আজ অবধি তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
আব্দুর রশিদের নানা নিযাতনের ব্যাপারে যবিপ্রবির ছাত্র আন্দোলনের নেতা আকিব ইবনে সাইফ জানিয়েছেন, বিগত সরকারের পক্ষে চাটুকারি করতেন আব্দুর রশিদ, নিয়োগ দুনীতি, দমন পিড়ণ. সিনিয়র মানহানিসহ সব ধরণের অপকর্মে জড়িত ছিলেন রশিদ। বিশেষ করে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দালনকে নস্যাত করতে ছাত্রলীগকে ও পুলিশকে উস্কানি দিতেন তিনি।
যবিপ্রবির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ডক্টর কেএম দেলোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, এমন কোন অনিয়ম নেই যা আব্দুর রশিদ করেননি। সাবেক উপাচার্যের যত দুর্নীতির অধিকাংশই এই রশিদের হাত দিয়েই হয়েছে। সকল নিয়োগে কাড়ি কাড়ি টাকা কামিয়েছন আরো ৪/ ৫ জনকে সাথে নিয়ে। চাকরি দেয়ার নামে লোকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে টাকা আদায় করেছেন। আর চাকরি না হলে সবাই টাকা ফেরত চাছেন। গত আন্দোলনে ছাত্রদের উপর নির্যাতনে তার ভূমিকা বেশি। ঢাকার কতিপয় নেতার নাম ভাঙিয়ে দাপট দেখিয়েছেন এই রশিদ। তার চাকরি থাকা অনুচিত।
এ ব্যাপারে যবিপ্রবির ভিসি প্রফেসর ডক্টর আব্দুর মজিদ জানান, রেজিস্টার এর কাছে অভিযোগ এসেছে। আমি কালকে বিশ্ববিদ্যালয় গেলে বিষয়টা বিস্তারিত জানতে পারব।