খুলনা শহর থেকে শত কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের কূলঘেষা কয়রা উপজেলার অসহায় জনগণের দুঃখ দুর্দশা নিত্যদিনের সঙ্গী। ঘূর্ণিঝড় আইলা, সিডর, আম্ফান, রেমালে বিধ্বস্ত উপকূলীয় কয়রা উপজেলা।
বারবার প্রাকৃতিক দূযোর্গে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটের কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় সহজে শত কি.মি দূরে জেলা সদরে চিকিৎসা নিতে পারে না এ অঞ্চলের জনগণ। এমনকি এ জনপদের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করায় জেলা শহরে গিয়ে ভালো চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হয়।
জেলা শহর থেকে উপজেলা পর্যন্ত ভালো সড়ক না থাকায় ও উপজেলায় বসবাসের অনেক অসুবিধা থাকায় বেশির ভাগ সময় চিকিৎসকরা প্রত্যন্ত এ জনপদে আসতে আগ্রহ দেখায় না।
সুন্দরবন উপকূলের এই উপজেলার ভাগ্যহত লক্ষাধিক মানুষের আপদকালীন বিপদে সর্বদা সাহায্য করবে এমন একজন চিকিৎসকের আশায় পথ চেয়েছিলো এ অঞ্চলের মানুষ, ঠিক সে সময়ে কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা হিসেবে ২০২৩ সালোর জানুয়ারি মাসে যোগদান করেন ৩৩ তম বিসিএস এর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ রেজাউল করিম রাজিব।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ রেজাউল করিম রাজিব যোগদানের পর চিকিৎসা সেবার মান বৃদ্ধির জন্য রাত দিন চেষ্টা করতে থাকেন। প্রয়োজনের তুলনায় মাত্র কয়েকজন চিকিৎসক নিয়ে জরাজীর্ণ ভবনে তিনি চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন শত সমস্যার মধ্যেও কিভাবে প্রান্তিক মানুষদেরকে উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়।
তাঁর জাদুর কাঠিতে এক এক করে পরিবর্তন হতে থাকে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিত্র। অল্প দিনেই ঘুরে দাঁড়ায় হাসপাতালটি।আগে যেখানে মানুষ চিকিৎসা সেবা নেওয়ার জন্য অনিহা প্রকাশ করতো, এখন সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীদের উপচে পড়া ভিড় থাকে।
চিকিৎসক রেজাউল করিম রাজিব বলেন, ‘কয়রাতে যোগদানের পর হাসপাতালের জরাজীর্ণতা আর ভঙ্গুরতা দেখে কথা দিয়েছিলাম যদি বেঁচে থাকি তাহলে হাসপাতালের একটা মানসম্মত অবস্থান আর আধুনিকায়ন করে দিবো।সেই লক্ষ্যে গত দেড় বছর অক্লান্ত পরিশ্রম আর হাজারো প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে কাজ করে গিয়েছি। দিনরাত একাকার করে একটার পর একটা সাইট নতুনভাবে তৈরি করা, রেনোভেশন, ইনোভেশন এর কাজ করেছি।’
ডা. রাজিব আরও বলেন, ‘বাসায় যাইনি মাসের পর মাস। হাসপাতালের মূল ভবন নির্মাণাধীন এবং দীর্ঘদিন থেকে নানাবিধ জটিলতায় কাজ বন্ধ হয়ে আছে। তাই ভবনের একাংশের মধ্যেই আমাকে স্বাস্থ্যসেবা চালিয়ে নেয়ার জন্য সবকিছুর ব্যবস্থা করতে হয়েছে।’
সরেজমিনে কয়রা উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ছোট একটি ভবনের নীচ তলায় সাজানো গুছানো ইমার্জেন্সি, আউটডোর, এনসিডি, আইএমসিআই, এএনসি ও পিএনসি, ব্রেস্ট ফিডিং কর্ণার, গ্লাস টিকেট কাউন্টার, ফার্মেসি, অফিস সাইট।
হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায় প্যাথলজী, টেস্ট রুম, নরমাল ডেলিভারি রুম, পোস্ট লেবার রুম, ওটি রুম, সেন্ট্রাল সার্ভার স্টেশন, কনফারেন্স রুম।
৩য় তলায় ইনডোর, নার্সেস ডিউটি রুম, ওয়ার্ড বয় রুম আর ছাদের একপাশে নতুনভাবে পরিপূর্ণ একটা পুরুষ ওয়ার্ড। এগুলোর অধিকাংশই সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি করতে হয়েছে আর কিছু রুম রেনোভেশন করে আধুনিকায়ন করা হয়েছে।আর বাইরে ফ্ল্যাগ স্টান্ড, পয়সনিং ওয়াশ রুম, অত্যাধুনিক পাবলিক ওয়াশ কর্ণার, আর মনোমুগ্ধকর তিলোত্তমা পুকুর পাড়।
হাসপাতালের বারান্দায় রোগীদের বেড থাকায় জানালায় থাই গ্লাস দেওয়া হয়েছে যাতে রোগীরা শীতে এবং বর্ষায় কষ্ট না পায় ।কম ওজনের নবজাতক বাচ্চাদের তাপমাত্রা ঠিক মাত্রায় রাখতে তাদের জন্য “ইনফ্যান্ট রেডিয়েন্ট ওয়ার্মার” নামক অত্যাধুনিক মেশিন চালু করা হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ রেজাউল করিম রাজিব দায়িক্ত নেয়ার দেড় বছরে এতোগুলো কাজ সম্পন্ন করেছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি এবং হাসপাতালের আসেপাশের নিকটস্থ মানুষদের সাথে নিয়ে সবকিছু পরিদর্শন পরবর্তী ব্যবহারের জন্য একটা আয়োজন করা হয়। ছোট্ট একটা ভবনের এতো সুযোগ সুবিধা দেখে মানুষজন রীতিমতো বিস্মিত হয়। এসময় তারা চিকিৎসক রেজাউল করিম রাজিবের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করে।
চিকিৎসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম রাজিব বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সরকারি এবং স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে একটা ভালো, সুন্দর সুসম্পর্ক থাকা অতি প্রয়োজন। জনসাধারণ এবং হাসপাতালের কর্মরতদের সাথে সুসম্পর্ক এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ দিতে পারে একটা মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা।’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্তরিক কৃতজ্ঞতা আমার সহকর্মী চিকিৎসকবৃন্দ, হাসপাতালের সকল স্টাফবৃন্দ এবং আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি। আমি কথা দিয়েছিলাম, আমি কথা রেখেছি। তবে পূর্ণাঙ্গ ভবন থাকলে নিশ্চিতভাবেই কাজগুলো একটা অসাধারণ হাসপাতালের রূপরেখা তৈরি করতো। তারপরও সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে যতোটুকু সম্ভব তার সবটুকুই করে দিয়েছি। আমার করা কমিটমেন্টের সবগুলো আমি পূরণ করেছি।’