হরিজন সম্প্রদায় সামাজিকভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত একটি জনগোষ্ঠী। সামাজিক দৃষ্টিতে হরিজনরা খুবই নিচু। এদের সঙ্গে সমাজের সাধারণ মানুষ মিশতে চায় না, কিন্তু সেই হরিজন সম্প্রদায়ের দু’বোনকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সমাজে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন চাইল্ড নট ব্রাইট প্রজেক্ট (CNB), যারা এখন প্রতিনিয়ত বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে বিভিন্ন প্রকার সচেতনতামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন গ্রামে গ্রামে, গ্রুপের মাধ্যমে তাদের এই কার্যক্রম দেখে সাধুবাদ জানিয়েছেন এলাকার সুধীজন।
বলছি নিজের বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে গ্রাম ও ইউনিয়নের বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করা হরিজন সম্প্রদায়ের আপন দুই বোন বৃষ্টি ও পলি রানী কথা। তাদের বাড়ি কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের পূর্ব ফুলমতি গ্রামে।
বাবা বাবলু দাস একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী, মাস শেষে যা বেতন পান তা দিয়ে কোনোভাবেই সংসার চললেও মাত্র ১৭ বছরে বড় মেয়ে পপি রাণীর বাল্যবিয়ে দেন। বাবলু দাসের তিনটি মেয়ে পপি, বৃষ্টি ও পলি রানী তিনজনেরই বয়স কাছাকাছি হওয়ায় সমাজের অবহেলা অনাদরের কারণে লোকজনের কথায় ছোট মেয়ে বৃষ্টির রানী ও পলি রানীর বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন বাবলু দাস, বাল্যবিবাহ করবেন না বলে বাবাকে জানিয়ে দেন মেয়ে পলি রানী ও বৃষ্টির রানী।
অল্প বেতনে যখন সংসার চলছে না তখন মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল বাবলু দাসকে, এক সময় গিয়ে বৃষ্টির রানী ও পলি রানী লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে ঠিক সেই সময় পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে চাইল্ড নট ব্রাইট প্রজেক্টের মহিদের যুব সমাজ কল্যাণ সমিতির সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বিভিন্ন ধরনের জীবন দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন পলি রানী, প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর ইউনিয়ন পর্যায়ে তিনটি গ্রুপে ঝরে পড়া ও গরীব অসহায় বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা কিশোরীদের প্রতিমাসে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক চারটা প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। এতে করে প্রতিটি প্রশিক্ষণ থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই কোনোভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে থাকেন পলি রানী, এভাবে এক সময় পলি রানী হয়ে উঠেন ইয়ুথ চ্যাম্পিয়ন। পলি রানী বর্তমানে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজে অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। লেখাপড়া শেষ করে হতে চান একজন আদর্শ শিক্ষিকা।
অন্যদিকে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে বড় বোনকে কাজ করতে দেখে আস্তে আস্তে বাল্যবিবাহের প্রতিরোধে কাজ করার আগ্রহ জন্মে ছোট বোন বৃষ্টি রানীর, প্রথমে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করলেও পরবর্তীতে মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতির কাছ থেকে এক মাসের সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে প্লান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের আর্থিক সহযোগিতায় কিছু টাকা পেলে সেই টাকা দিয়েই কেনেন একটি সেলাই মেশিন, বাড়ির আশেপাশে মানুষের কাপড় সেলাই করে তা থেকে যা আয় হয় তা দিয়ে এখন ভালোভাবে চলছে বৃষ্টি রানী লেখাপড়া, অপরদিকে মহিদেব যুব কল্যাণ সমিতির সহযোগিতায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের প্রশিক্ষণ নিয়ে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বাল্যবিবাহের প্রতিরোধে সচেতনামূলক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। চলতি বছরেই বৃষ্টি রানী এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে, লেখাপড়া শেষ করে হতে চান সেবিকা। বৃষ্টি রানী বর্তমানে একজন একজন কিশোরী দলের চ্যাম্পিয়ন অফ চেঞ্জ।
পলি ও বৃষ্টি রানীর বাবা বাবলু দাস জানান, আমি সামান্য একজন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী যা বেতন পাই তা দিয়ে সংসারী চলে না, তিন মেয়ের লেখাপড়ার খরচ চালানো আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই বড় মেয়ের কম বয়সে বিয়ে দিয়েছি, কিন্তু ছোট দুই মেয়ে কম বয়সে বিয়ে করতে রাজি হয়নি। তারা নিজের বিয়ে নিজেই ঠেকিয়েছে, এছাড়া তারা এখন নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেরাই চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের মত হরিজন সম্প্রদায়ের দু’টি মেয়েকে বাল্যবিবাহের হাত থেকে রক্ষাসহ যে ধরনের সহযোগিতা মহিদের যুব সমাজ কল্যাণ সমিতি করে যাচ্ছে তার জন্য আমি সেই সংস্থাকে ধন্যবাদ জানাই।
পলি ও বৃষ্টির রানী জানান, সমাজের মানুষরা এখনো আমাদেরকে অন্য চোখে দেখে, আমাদের লেখাপড়া যখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম ছিল ঠিক তখনই আমাদের পাশে এসে মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতি দাঁড়িয়েছিল, তাদের সহযোগিতায় আমাদের লেখাপড়া আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। সেই সঙ্গে সমাজে বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে থাকা মেয়েদের বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি।
নাওডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাছেন আলী জানান, হরিজন সম্প্রদায়ের মেয়ে হয়ে পলি ও বৃষ্টি রানী আমার ইউনিয়নে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে যে ধরনের কাজ করে যাচ্ছে সেজন্য আমি তাদেরকে সাধুবাদ জানাই, সেই সঙ্গে এ ধরনের কাজে তাদেরকে সম্পৃক্ত করার জন্য মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতিকে ধন্যবাদ জানাই।
এ ব্যাপারে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা সোহেলী পারভীন জানান, ফুলবাড়ী উপজেলায় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে ‘চাইল্ড নট ব্রাইট’ প্রজেক্টের মহিদেব যুব সমাজ কল্যাণ সমিতি যে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে তা সত্যি প্রশংসার দাবিদার, তবে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে জনপ্রতিনিধি কাজী মুন্সিসহ আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।