আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী মাটি ও ছন বাঁশের ঘর। মাটি ও চন বাঁশের ঘরের স্থান দখল করে নিচ্ছে ইট-পাথরের দালান ও টিন। শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুতেই মাটির ও চন বাঁশের ঘর আরামদায়ক। গ্রামবাংলার চির ঐতিহ্যের নিদর্শন ছায়া ঘেরা শান্তির নীড় ছিল মাটি ও ছন বাঁশের ঘর, যা এক সময় গ্রামের মানুষের কাছে “গরীবের এসি বাড়ি” নামে পরিচিত ছিল। কালের বিবর্তণে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের মাটির ঘর। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মাটির ঘরের জায়গায় তৈরি হচ্ছে ইটের বাহারী দালান।
মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতা, প্রযুক্তির উন্নয়ন, রুচিবোধের পরিবর্তন, পারিবারিক নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের সুরক্ষার কারণে এখন আর কেউ মাটি ও ছন বাঁশের ঘরে থাকতে চান না। সচ্ছল মানুষরা এখন ঝুঁকে পড়েছেন পাকা দালানের দিকে। তারপরও মানুষ যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাকা দালানকোঠা তৈরি করছেন। তাই আধুনিকতার ছোঁয়ায় আর সময়ের পরিবর্তনে গ্রামবাংলা থেকে ঐতিহ্যবাহী মাটির তৈরি ঘর আজ প্রায় বিলুপ্তের পথে। একদিন সেই মাটি ও ছনের ঘরটির স্থান হবে ইতিহাসে অথবা যাদুঘরে।
মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন চা বাগানগুলোতে এখনো কিছু মাটির ঘর দেখা যায়। তবে সেগুলোও বেশিদিন থাকবে না হয়তো। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে বাগানগুলোতেও। কম-বেশি সব বাগানগুলোতে দালানকোঠা তৈরি হচ্ছে। কারণ যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে এখন অনেকে ইটের ঘর তৈরি করছে, তাই ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে এমন মাটির ঘর। বাংলার ছেলে মেয়েরা বাস্তবে মাটি ও চনের ঘর যেন দেখতে পারে তাই সখ করে গ্রামে কিছু রেখে দিয়েছেন অনেকে, তাও বিরল। তবে, এখন মাটি ও সনের ঘরের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় বিলুপ্তির কাছাকাছি।
এদিকে কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আলীনগর চা বাগানে গেলে দেখা যায়, চা বাগানের বিভিন্ন টিলায় এখানো মাটির ঘর আছে। চা শ্রমিকরা পরিবার-পরিজন নিয়ে আরামদায়কভাবেই বসবাস করছেন। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না থাকায় আধুনিকতার ছোঁয়াও লাগেনি তাদের মাঝে।
তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগের তুলনায় এখন মাটির ঘর খুব কম। হয়তো সেটাও থাকবে না। হয়ে যাবে দালানকোঠা। পরবর্তী প্রজন্ম ছেলে-মেয়েরা মাটির ঘরের গল্প, কবিতার ছন্দে বা সাহিত্যর পাতায় বা যাদুঘরে দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের কাছে শুধু নাটক, সিনেমা ও গল্প কাহিনী রয়ে যাবে।
মাটির ঘরের কারিগর দুলাল, রইছ ও কনু মিয়া বলেন, “মাটির ঘর তৈরি করতে কারিগরদের তিন-চার মাসের অধিক সময় লাগতো। মজুরি হিসেবে একটা ঘরের জন্য ৩০-৩৫ হাজার টাকা নিতেন। এখন আর মাটির ঘর কেউ নির্মাণ করে না। তাই আমাদেরও আগের মতো কাজ নাই। এখন অন্য কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকি।”
মাধবপুর চা বাগানের বাসিন্দা অজয় মুন্ডা জানান, “মাটির ঘর বসবাসের জন্য আরামদায়ক হলেও যুগের বিবর্তণে অধিকাংশ মানুষ মাটির ঘর ভেঙে অধিক নিরাপত্তা ও স্বল্প জায়গায় অনেক লোকের বসবাসের জন্য ইটের ঘরকে পছন্দের তালিকায় প্রথমে নিয়ে এসছে। তিনি বলেন, মাটির ঘর শীত কিংবা গরম উভয় মৌসুমেই বেশ আরামদায়ক।”
এদিকে আলীনগর চা বাগানের বাসিন্দা ও শিক্ষক রাজেস কৈরী বলেন, “যুগ যুগ ধরে আমরা মাটির ঘরে বসবাস করছি। আমাদের তেমন টাকা-পয়সা নাই পাকা ঘরে থাকবো যে। আরামের জন্য মাটির ঘরই ভালো।
তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের বাগানে মাটির ঘরের স্থান দখল করে নিয়েছে ইট, সিমেন্ট, বালু ও রডের তৈরি পাকা ঘর। মাটির ঘরগুলোর বন্যা ও ঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশেষ ক্ষতি হয় বলেই মানুষ ইট-সিমেন্টের ঘরবাড়ি নির্মাণে আগ্রহী হচ্ছেন। প্রতি বছর মাটির ঘরে খরচ না করে একবারে বেশি খরচ হলেও পাকা ঘরবাড়িই নির্মাণ করছেন। তবে এখন মাটির ঘরের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় বিলুপ্তির কাছাকাছি। হয়তো সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন মাটির ঘরের কথা মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাবে। আগামী প্রজন্মের মানুষের কাছে মাটির ঘর রূপকথার গল্পের মতো মনে হবে।”
মাটির ঘর কেন কমে যাচ্ছে সে ব্যাপারে জানতে চাইলে কমলগঞ্জের লেখক ও গবেষক আহমদ সিরাজ বলেন, “মানুষ এখন কর্মমুখী। মানুষের আয়-রোজগার বাড়ার কারণে মানুষ দিন দিন শৌখিন হয়ে উঠছে। জেলার প্রচুর মানুষ বিভিন্ন দেশে গিয়ে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল হয়েছেন। প্রবাসী ও সচ্ছল ব্যক্তিরা তাদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে মাটির ঘরে থাকতে চান না। এজন্য মাটির ঘর ভেঙে বিভন্ন ধরনের ডিজাইন করে পাকা দালানকোঠা নির্মাণ করছেন। তবে এখন মাটির ঘরের সংখ্যা কমতে কমতে প্রায় বিলুপ্তির কাছাকাছি।”