ঢাকা ১১:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৭ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ৫ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই মাত্র পাওয়াঃ
ফুলবাড়ীতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেত্রী দোলনা আক্তার গ্রেপ্তার মৌলভীবাজারে বাবার হাতে ছেলে খুন, ঘাতক পিতা আটক মঠবাড়িয়ায় প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির সাথে অশোভনীয় আচরণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন ময়মনসিংহ জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভা অনুষ্ঠিত কিশোরগঞ্জে দিনে দুপুরে পুলিশ পরিচয়ে ব্যবসায়ীকে সিএনজিতে তুলে নিয়ে টাকা ছিনতাই জয়পুরহাটে ১৪৪ ধারা জারি ডিমলায় র‍্যাবের হাতে ফেন্সিডিলসহ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার টুঙ্গিপাড়ায় মেয়াদোত্তীর্ণ মাছের খাবার বিক্রি: ৫ হাজার টাকা জরিমানা পাবনায় জামায়াতের অফিসে হামলা-ভাংচুরের অভিযোগ বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পাইকগাছার রাড়ুলী ইউপি চেয়ারম্যানের পদত্যাগ বদলগাছীতে ৮ হাজার ২শ ২০ বিঘা জমিতে সরিষা উৎপাদন সাবেক মন্ত্রী নুর মোহাম্মদ খানের মতবিনিময়

ভালো নেই সুনীলের কুলা তৈরির ঐতিহ্য

সুনীল চন্দ্র ক্ষত্রীয়। পঞ্চাশোর্ধ একজন কুশলী কারিগর। যিনি কুলা বানানোর কাজকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। উপজেলার রাজিবপুর ইউনিয়নের বৃ-ঘাগড়া গ্রামে তার বাড়ি। তার পিতার নাম ধীরেন্দ্র চন্দ্র ক্ষত্রীয়। পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই এই কাজটি তার পরিবারের পেশা। ছোট্ট একটি গ্রামে, যেখানে মাটির গন্ধ আর ধানের ক্ষেতের সবুজতা মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে, সেখানেই তার কুলা তৈরির ছোট্ট কারখানা।

কারখানা বলতে তার নিজের বসবাসের ঘর। পরিবারের সবাই মিলে এই পেশার সাথে জড়িত শত শত বছর ধরে। এই পেশা শুধু তার জীবিকা নয়, এটি তার ঐতিহ্য, তার পরিবার আর সমাজের কাছে একটি স্বস্তির পরিচয়। তাই শত বাঁধা-বিপত্তির পরেও, আর্থিক অনিশ্চয়তার পরেও, শত বছর যাবৎ ধরে রেখেছেন পূর্বপুরুষদের এই ঐতিহ্য।

কুলা তৈরির কাজটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং ধৈর্যের। বাঁশ কাটা থেকে শুরু করে, কুলার কাঠামো তৈরি করা এবং পরিশেষে তা আকারে নিয়ে আসা, প্রতিটি ধাপে প্রয়োজন হয় নিখুঁত দক্ষতা। সুনীল চন্দ্র ক্ষত্রীয় এবং তার পরিবার, প্রতিটি কুলা তৈরি করেন ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে।

সুনীল চন্দ্রের পরিবারে সদস্য ৬ জন। মূলত সবাই এই কাজের সাথেই জড়িত। মহিলারাও এই কাজে সমান অংশীদার। তারা বাঁশ কাটার পর বুনন কাজটি সম্পন্ন করেন। তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় কুলাগুলো হয়ে ওঠে দৃঢ় এবং টেকসই। তবে মহিলারা কুলার চেয়ে ঝুড়ি তৈরিতে সময় দেন বেশি।

সবকিছু গোছানো থাকলে দিনে সর্বোচ্চ ৩/৪ টি কুলা বানাতে পারেন একেকজন। আর বাঁশ কাটা, বেত তোলা এসব করার সময় বিবেচনা করলে, দিনে ১/২ টার বেশি কুলা তৈরি করতে পারেন না। ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেন ১০০ কুলা। পরবর্তীতে খুচরা বাজারে ১০০ টাকায় প্রতি কুলা বিক্রি হয়। বৈশাখ আর অগ্রহায়ণ মাসে মোটামুটি ভালো পরিমাণে কুলা বিক্রি হয়।

কুলা তৈরি করে সুনীল চন্দ্র ক্ষত্রীয় এগুলো স্থানীয় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। বাজারে তার তৈরি কুলার বেশ চাহিদা রয়েছে। কারণ এগুলো খুবই টেকসই এবং সুন্দর। তবে কুলা বিক্রির সোনালী সময় এখন আর নেই বলে জানান সুনীল চন্দ্র। তার পূর্বপুরুষরা যেরকম ব্যবসা করতে পেরেছে, তা তিনি পারছেন না। প্রযুক্তির উৎকর্ষতা, প্লাস্টিকের ব্যবহার বিভিন্ন কারণে কমেছে কুলাসহ বাঁশের তৈরি জিনিসের ব্যবহার। তাছাড়া বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় তেমন সুবিধা করা যাচ্ছে না কুলা তৈরি করে। তাই দিন দিন ভাটা পড়ছে কুলার ব্যবসায়।

মোটা দাগে বলতে গেলে, বর্তমানে চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে এই পেশা। তাই ঐতিহ্যের এই ব্যবসায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে। এছাড়াও সারাবছর কুলার সমান চাহিদা না থাকায়, বছরের বেশিরভাগ সময় কষ্ট করেই পাড় হয় সুনীল চন্দ্রের। টানাপোড়েনের সংসারে তখন আর্থিক সমস্যা তীব্র হয়। অল্প রোজগারের সংসারে দিন পাড় হয় না সুনীলের। তবে হাতে জমানো টাকা থাকলে, আগে থেকে বাঁশ কিনে রাখলে সিজনে ভালো ব্যবসা হতো বলে মনে করেন সুনীল। বর্তমানের আয় দিয়ে পেট চলে না ঠিক মতো, তাই টাকা জমানোর কোনো সুযোগই নেই তার। তবুও সুনীল চন্দ্র ক্ষত্রীয় তার পূর্বপুরুষদের পেশাকে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। তিনি বিশ্বাস করেন, ঐতিহ্য ধরে রাখার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ।

এলাকাবাসী জানায়, সুনীল চন্দ্র ক্ষত্রীয়ের কুলা তৈরির গল্প শুধু তার পরিবারের নয়, এটি একটি সমাজের ঐতিহ্যের গল্প। প্রতিদিনকার কঠোর পরিশ্রম আর নিখুঁত দক্ষতায় তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন এক পুরনো পেশা। তার এই কাজ শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়, বরং এটি ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। সুনীল চন্দ্রের মতো মানুষরা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, পুরনো পেশাগুলো আমাদের শিকড় এবং সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। এই গল্পটি তাই কেবল একটি পরিবারের নয়, বরং একটি সমাজের ইতিহাস।

ট্যাগস :

আপনার মতামত লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল ও অন্যান্য তথ্য সঞ্চয় করে রাখুন

জনপ্রিয় সংবাদ

ফুলবাড়ীতে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেত্রী দোলনা আক্তার গ্রেপ্তার

Verified by MonsterInsights

ভালো নেই সুনীলের কুলা তৈরির ঐতিহ্য

আপডেট সময় ০৭:১৭:১৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

সুনীল চন্দ্র ক্ষত্রীয়। পঞ্চাশোর্ধ একজন কুশলী কারিগর। যিনি কুলা বানানোর কাজকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। উপজেলার রাজিবপুর ইউনিয়নের বৃ-ঘাগড়া গ্রামে তার বাড়ি। তার পিতার নাম ধীরেন্দ্র চন্দ্র ক্ষত্রীয়। পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই এই কাজটি তার পরিবারের পেশা। ছোট্ট একটি গ্রামে, যেখানে মাটির গন্ধ আর ধানের ক্ষেতের সবুজতা মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে, সেখানেই তার কুলা তৈরির ছোট্ট কারখানা।

কারখানা বলতে তার নিজের বসবাসের ঘর। পরিবারের সবাই মিলে এই পেশার সাথে জড়িত শত শত বছর ধরে। এই পেশা শুধু তার জীবিকা নয়, এটি তার ঐতিহ্য, তার পরিবার আর সমাজের কাছে একটি স্বস্তির পরিচয়। তাই শত বাঁধা-বিপত্তির পরেও, আর্থিক অনিশ্চয়তার পরেও, শত বছর যাবৎ ধরে রেখেছেন পূর্বপুরুষদের এই ঐতিহ্য।

কুলা তৈরির কাজটি অত্যন্ত শ্রমসাধ্য এবং ধৈর্যের। বাঁশ কাটা থেকে শুরু করে, কুলার কাঠামো তৈরি করা এবং পরিশেষে তা আকারে নিয়ে আসা, প্রতিটি ধাপে প্রয়োজন হয় নিখুঁত দক্ষতা। সুনীল চন্দ্র ক্ষত্রীয় এবং তার পরিবার, প্রতিটি কুলা তৈরি করেন ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে।

সুনীল চন্দ্রের পরিবারে সদস্য ৬ জন। মূলত সবাই এই কাজের সাথেই জড়িত। মহিলারাও এই কাজে সমান অংশীদার। তারা বাঁশ কাটার পর বুনন কাজটি সম্পন্ন করেন। তাদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় কুলাগুলো হয়ে ওঠে দৃঢ় এবং টেকসই। তবে মহিলারা কুলার চেয়ে ঝুড়ি তৈরিতে সময় দেন বেশি।

সবকিছু গোছানো থাকলে দিনে সর্বোচ্চ ৩/৪ টি কুলা বানাতে পারেন একেকজন। আর বাঁশ কাটা, বেত তোলা এসব করার সময় বিবেচনা করলে, দিনে ১/২ টার বেশি কুলা তৈরি করতে পারেন না। ৬ হাজার টাকায় বিক্রি করেন ১০০ কুলা। পরবর্তীতে খুচরা বাজারে ১০০ টাকায় প্রতি কুলা বিক্রি হয়। বৈশাখ আর অগ্রহায়ণ মাসে মোটামুটি ভালো পরিমাণে কুলা বিক্রি হয়।

কুলা তৈরি করে সুনীল চন্দ্র ক্ষত্রীয় এগুলো স্থানীয় পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। বাজারে তার তৈরি কুলার বেশ চাহিদা রয়েছে। কারণ এগুলো খুবই টেকসই এবং সুন্দর। তবে কুলা বিক্রির সোনালী সময় এখন আর নেই বলে জানান সুনীল চন্দ্র। তার পূর্বপুরুষরা যেরকম ব্যবসা করতে পেরেছে, তা তিনি পারছেন না। প্রযুক্তির উৎকর্ষতা, প্লাস্টিকের ব্যবহার বিভিন্ন কারণে কমেছে কুলাসহ বাঁশের তৈরি জিনিসের ব্যবহার। তাছাড়া বাঁশের দাম বেড়ে যাওয়ায় তেমন সুবিধা করা যাচ্ছে না কুলা তৈরি করে। তাই দিন দিন ভাটা পড়ছে কুলার ব্যবসায়।

মোটা দাগে বলতে গেলে, বর্তমানে চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে এই পেশা। তাই ঐতিহ্যের এই ব্যবসায় টিকে থাকাই কঠিন হয়ে গেছে। এছাড়াও সারাবছর কুলার সমান চাহিদা না থাকায়, বছরের বেশিরভাগ সময় কষ্ট করেই পাড় হয় সুনীল চন্দ্রের। টানাপোড়েনের সংসারে তখন আর্থিক সমস্যা তীব্র হয়। অল্প রোজগারের সংসারে দিন পাড় হয় না সুনীলের। তবে হাতে জমানো টাকা থাকলে, আগে থেকে বাঁশ কিনে রাখলে সিজনে ভালো ব্যবসা হতো বলে মনে করেন সুনীল। বর্তমানের আয় দিয়ে পেট চলে না ঠিক মতো, তাই টাকা জমানোর কোনো সুযোগই নেই তার। তবুও সুনীল চন্দ্র ক্ষত্রীয় তার পূর্বপুরুষদের পেশাকে ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। তিনি বিশ্বাস করেন, ঐতিহ্য ধরে রাখার মধ্যেই রয়েছে প্রকৃত সুখ।

এলাকাবাসী জানায়, সুনীল চন্দ্র ক্ষত্রীয়ের কুলা তৈরির গল্প শুধু তার পরিবারের নয়, এটি একটি সমাজের ঐতিহ্যের গল্প। প্রতিদিনকার কঠোর পরিশ্রম আর নিখুঁত দক্ষতায় তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন এক পুরনো পেশা। তার এই কাজ শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের মাধ্যম নয়, বরং এটি ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক। সুনীল চন্দ্রের মতো মানুষরা আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, পুরনো পেশাগুলো আমাদের শিকড় এবং সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। এই গল্পটি তাই কেবল একটি পরিবারের নয়, বরং একটি সমাজের ইতিহাস।