ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার আজমপুর এলাকায় পরিবেশ দূষণের অভিযোগের প্রেক্ষিতে ইটভাটা সরেজমিনে পরিদর্শন এবং অনুসন্ধানে পাওয়া যায় বিশাল দুর্নীতির এক ভয়াবহ তথ্যচিত্র।
স্থানীয় বরাত থেকে জানা যায়, আজমপুর এলাকায় মেসার্স দৌলত ব্রিকস নামক ইটভাটার দূষণের অভিযোগ নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরে গেলে সহকারী পরিচালক বদরুন্নাহার সীমা অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং ইটভাটার পক্ষে সাফাই দেন।
স্থানীয় একজন অভিযোগকারী জানান, তিনি ২০২১ সালে মারাত্মক দূষণকারী ইটভাটার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক নুরুল আমীন ইটভাটা সরেজমিনে পরিদর্শন করে ১ কিলোমিটারের মধ্যে একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, রেলস্টেশন ও তিন ফসলী জমির অবস্থান থাকায় ইটভাটার ছাড়পত্র বাতিলের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম অঞ্চলিক কার্যালয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নথি প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে অভিযোগকারী চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক মহোদয়ের সাথে দেখা করলে আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক জানান, ইটভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র বাতিল করা হয়েছে এবং স্থানীয় জেলা কার্যালয়কে ইটভাটা উচ্ছেদের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন।
তিনি জানান, পরিচালক মুফিদুল আলম মহোদয় অভিযোগকারীর নিকট একটি আদেশের কপি দেন, যেখানে উল্লেখ রয়েছে “ইটভাটার ১ কিলোমিটারের মধ্যে নিষিদ্ধ এলাকার অবস্থান থাকায় ছাড়পত্র বাতিল করা যেতে পারে।”
জানা যায়, বিগত ২৮/১১/২০২১ তারিখে পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক মুফিদুল আলম এর সভাপতিত্বে আঞ্চলিক কার্যালের ছাড়পত্র কমিটির ২৪৭তম সভায় সিদ্ধান্ত গ-১১ অনুসারে ইটভাটার ছাড়পত্র বাতিল করা হয়। অথচ ইটভাটা পরিদর্শনে গেলে ইটভাটা কর্তৃপক্ষ হালনাগাদ ছাড়পত্র কপি প্রদর্শন করেন। প্রদর্শিত ছাড়পত্রের নং- ২৩-১১০৩১৫ এর মেয়াদ ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪।
২০২১ সালে ছাড়পত্র বাতিল করা হলে ২০২৪ সাল পর্যন্ত হালনাগাদ নবায়ন কিভাবে থাকে এমন প্রশ্নের অনুসন্ধানকালে ইটভাটার মালিক জানান, ৪ লক্ষ টাকা স্থানীয় অফিসে ঘুষ দিয়ে এবং আঞ্চলিক কার্যালয়ে ১ লক্ষ টাকা জরিমানা পরিশোধ করে ভাটার ছাড়পত্র হালনাগাদ করে নেন। এ ব্যাপারে দপ্তরের সহকারী পরিচালক বদরুন্নাহার সীমা সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সচেতন মহল মনে করেন, দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও তাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে অপসারণ না করায় তার দুর্নীতির মাত্রা দিনদিন বেড়েই চলেছে, যার ফলশ্রুতিতে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোকজন আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি এবং চরম বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছি।
তারা আরো বলেন, বদরুন্নাহার সীমা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পূর্বের লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও নবায়ন না দিয়ে তাদের কাছে টাকা দাবি করে বিভিন্নভাবে তাদেরকে হয়রানি করছেন। অথচ তিনি আওয়ামী লীগ পন্থি মালিকদের বিভিন্ন অবৈধ কারখানা এবং ইটভাটা রক্ষা করার দায়িত্ব নিয়ে তাদেরকে রক্ষা করার পূর্ণ প্রতিশ্রুতি প্রদান করে থাকেন।
ইটভাটা পরিদর্শনকালে দেখা যায়, ভাটার ৬০০ মিটারে মধ্যে রামধন নগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৬২০ মিটারের মধ্যে আজমপুর রেলওয়ে নূরানী হফেজী মাদ্রাসা, ৬৫০ মিটারের মধ্যে আমোদাবাদ আলহাজ্ব শাহ-আলম উচ্চ বিদ্যালয়, ৬৪০ মিটারের মধ্যে আমোদাবাদ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১ কিলোমিটারের মধ্যে তিন ফসলী জমিতে ফসলের প্রাণ সংহারের মহাউৎসব মেসার্স দৌলত ব্রিকস এর।
পরিবেশ আইন অনুসারে, উল্লিখিত সরকারি স্থাপনাসমূহের ১ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ এরকম ভয়াবহ অবস্থান চিত্রের মধ্যেও চলছে মেসার্স দৌলত ব্রিকস এন্ড কোং।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, “আমার কথা একদম স্পষ্ট। যদি কোনোো ইটভাটা থেকে পরিবেশ দূষিত হয় বা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ যে সকল বৈধ কাগজপত্র থাকার কথা তা না থাকে, তাহলে আমরা সে সকল ইটভাটার বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা নেব। আর কোনোো অবস্থাতেই আমরা ইটভাটায় কাঠ পোড়ানোকে সমর্থন করি না। কোনো ইটভাটায় কাঠ পোড়ানো হলে তাদের বিরুদ্ধেও দ্রুত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
স্থানীয়রা জানান, বেশিরভাগ ইটভাটার নেই প্রশাসনের লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র। এসব ভাটায় কয়লার পরিবর্তে নির্বিঘ্নে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। বিষাক্ত ধোঁয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গাছপালা, কমে গেছে ফসলের উৎপাদন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় বছরের পর বছর মেসার্স দৌলত ব্রিকস কোং অবাধে চালাচ্ছে তাদের অবৈধ ইটভাটা। এসব ভাটাতেও নির্বিঘ্নে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
উল্লেখ্য, পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ১৭৭টি ইটভাটার মধ্যে অনুমোদন আছে মাত্র ৬০টির এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ১১৭টির অধিক অবৈধ ইটভাটা রয়েছে।
উপ-পরিচালক মোঃ নয়ন মিয়ার সাথে ফোনে কথা বললে তিনি এই ইটভাটার কোনো তথ্য জানেন না মর্মে অবহিত করেন। তিনি এ ব্যাপারে সহকারী পরিচালক বদরুন্নাহার সীমার সাথে কথা বলতে বলেন।
বদরুন্নাহার সীমার সাথে কথা বললে তিনি জানান, তিনি একাধিকবার ইটভাটা পরিদর্শন করেছেন ইটভাটার ১ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কোনো নিষিদ্ধ এলাকা নেই।
পরিবেশ অধিদপ্তর যখন অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে তৎপর এবং কঠোর অবস্থানে, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সীমার তথ্যচিত্র সম্পূর্ণ উল্টো। তিনি যেন পরিবেশ বিক্রির সমস্ত অপকৌশল রপ্ত করে দুর্নীতির মহাউৎসবে মত্ত। দেখবে কে, সরিষার মধ্যের ভূত!
স্থানীয় এলাকাবাসীর একটাই দাবি, “বন্ধ হোক দূষণকারী ইটভাটা, বন্ধ হোক দুর্নীতি।” সেই সাথে অনতিবিলম্বে পদক্ষেপ নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কার্যালয়ের আওয়ামী দোসর সহকারী পরিচালক বদরুন্নাহার সীমার বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে তার বিরুদ্ধে আইনুনাগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জোর দাবি জানান সর্বস্তরের জনগণ।