জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল ভূমি অফিসের তহশিলদারের আদায় করা টাকা যায় অন্যান্য টেবিলে। টাকা ছাড়া হয় না নামজারী, দরকষাকষি ছাড়া নেওয়া যায় না খাজনার রশিদ ও অন্যান্য সেবা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ক্ষেতলাল ভূমি অফিসে তহশিলদাররা দলিল লেখক (মোহরা) ও নকল নবিসদের সঙ্গে আঁতাত করে নামজারীর আবেদন গ্রহণ করে। তারা প্রতিটি নামজারী আবেদন পাস করতে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা নিয়ে ডিসিয়ার প্রদান করেন। খাজনা আদায়ের রশিদের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের প্রমাণও মিলেছে। এর বেশিরভাগ যায় তহশিলদার, সার্ভেয়ার ও নোটিশ জারীকারকসহ অন্যান্য টেবিলে।
নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাদের (তহশিলদার) বিরুদ্ধে। একাধিক মহল থেকে সতর্ক করার পরও কোনো প্রতিকার মিলছে না ক্ষেতলাল ভূমি অফিসে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন সহকারী ভূমি কর্মকর্তাদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড ও অনিয়মের কারণে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। বড়াইল ইউনিয়ন ভূমি অফিসে খাজনা আদায়ের সময় ৫০০ টাকার রশিদ দিয়ে অতিরিক্ত ৪-৫ হাজার টাকা আদায় করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন তহশিলদারকে এমন অভিযোগে একাধিকবার শোকজ করেও কোনো পরির্বতন হয়নি। বড়তারা ইউনিয়ন ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুয়া জাল দলিলে নামজারীর অভিযোগও আছে। সাংবাদিকদের তোপের মুখে তা বাতিল করতে বাধ্য হয় উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি)।
তহশিলদার মো. মোমিনুল হক গত বছর (২০২৪) এ উপজেলায় যোগদান করেন। এরপর থেকে বেড়ে যায় ভূমি অফিসে দালালের দৌরাত্ম। অল্প সময়ের মধ্যে দলিল লেখক (মোহরা) ও নকল নবিসদের সঙ্গে সক্ষতা গড়ে তাদের হাতেই করেন এসব অনিয়মের লেনদেন। মোমিনুল হক কয়েক মাস ক্ষেতলাল সদর ও বড়াইল ইউনিয়ন ভূমি অফিসে সপ্তাহে দুইদিন বসতেন। তিনি ওই অফিসে নিয়ম বর্হিভূতভাবে একজন ব্যক্তিগত সহকারী রেখেছেন। ওই ব্যক্তিগত সহকারীকে (ভূমি মন্ত্রণালয়ের) গোপন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে ভূমি উন্নয়ন কর (খাজনা) আদায় ও অনলাইন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম করতে দেখা গেছে।
গোপন সূত্রে জানা গেছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার যোগসাজসে ওই ব্যক্তিগত সহকারীর দ্বারা খাজনা আদায়ের নামে রশিদের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের কাজ করেন। সরেজমিনে তদন্ত ও নোটিশ জারি ছাড়াই নালিশী সম্পত্তিরও নামজারীর প্রস্তাব পাস করে। টাকা না দিলে নামজারী আবেদনকারীর নামের আঁকার ওকার ভুল ধরে বাতিল করে। এতে সাধারণ ভূমি মালিকরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে তার দ্বারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন দলিল লেখক জানান (তাদের গোপন ভিডিও রেকর্ড দৈনিক বাংলাদেশ সময় এর হাতে সংরক্ষিত আছে), সার্ভেয়ার ও তহশিলদার মোমিনুল হক আসার পর থেকে কাজের রেট বেড়ে গেছে। মিস কেসের সিরিয়াল ও তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য দিতে হয় ১-১০ হাজার টাকা, নামজারীর তদন্ত প্রতিবেদন বাবদ দিতে হয় এক হাজার টাকা। মিস কেসের শুনানীর জন্য যোগাযোগ না করলে দীর্ঘ তারিখ জুড়ে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তার নির্দিষ্ট চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে সিরিয়াল নিয়ে মিস কেসের শুনানী ও প্রতিবেদন দাখিল করে।
উপজেলার পশ্চিম সরাইল দাসড়া মৌজার হাজী হাড়ী সরদার ওয়াক্ফ এস্টেটের মোতওয়াল্লী ভুক্তভোগী ওয়ারেছুল মজিদ কদর বলেন, “জনৈক নবিউল ইসলাম চৌধুরী একখন্ড রেওয়াজ দলিল মূলে গত ২ জানুয়ারিতে ওই ওয়াক্ফ এস্টেটের তফসিলভুক্ত ১৮ শতক সম্পত্তির নামজারী আবেদন করেন। উভয় পক্ষে শুনানীর পর নামজারী আবেদনটি না মঞ্জুর (বাতিল) করেন উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিন্নাতুল আরা। আবার তহশিলদার মো. মোমিনুল হক যোগদানের পর একই ব্যক্তি ওই সম্পত্তির গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর পুনরায় নামজারীর আবেদন করেন। ওই তহশিলদার ও সার্ভেয়ার কবির উদ্দিনের যোগসাজশে নোটিশ জারি গোপন রেখে সরেজমিনে পরির্দশন ছাড়াই নামজারী আবেদন (খারিজ) প্রদান করেন এসিল্যান্ড জিন্নাতুল আরা। ওই ওয়াক্ফ এস্টেটের তফসিলভুক্ত সম্পত্তি আদালতে বিচারাধীন মোকদ্দমার যাবতীয় কাগজপত্র ও বাংলাদেশ ওয়াক্ফ প্রশাসকের স্মারকে চিঠি নথিযুক্ত করার পরও ওই কাগজপত্র গোপন রেখে নামজারী প্রদান করেন।”
তিনি বলেন, “গত ১৫ অক্টোবর খারিজ বাতিল চেয়ে আবেদন করে, অজানা কারণে খারিজ বাতিলের কোনো অগ্রগতি হয় না। তখন ডিসি অফিস ও সাংবাদিকদের অভিযোগ করে তাদের চাপে নামজারী বাতিল করে।”
ভুক্তভোগী সাজাদুর রহমান শাহিন বলেন, “গত ২৪ অক্টোবর শাখারুঞ্জ মৌজার দুইটি খতিয়ানের ৫৯ শতক ধানী জমির খাজনা দেওয়ার জন্য বড়াইল ইউনিয়ন ভূমি অফিসে যাই। তহশিলদার মো. মোমিনুল হক ব্যস্ততা দেখিয়ে তার ব্যক্তিগত সহকারীর সঙ্গে কথা বলে খাজনার রশিদ নিতে বলে। ওই সহকারী সাত সতের হিসাব দিয়ে প্রথমে ৮ হাজার টাকা চায়। পরে দরকষাকষি করে ৪ হাজার টাকায় মীমাংসা হয়। ওই টাকা নিয়ে মাত্র ৫ শত ২০ টাকার দু’টি অনলাইন রশিদ দেয়। ওই ঘটনা যুগান্তর প্রতিনিধিকে জানালে, তিনি তহশিলদার মুমিনুলকে মোবাইল ফোনে জানালে ওই তহশিলদার আমাকে ডেকে সমোদয় টাকা ফেরত দেয়।”
ভুক্তভোগী ভূমি মালিক আলহাজ্ব আ. গফুর বলেন, “আমার বয়স ৭০ বছর একটি খারিজ বিষয়ে ক্ষেতলাল সদর ভূমি অফিসে তসিলদার মুমিনের কাছে জানতে চেয়েছি। উনি রেগে গিয়ে আমাকে বলে তুমি বড়াইলের বিষয় ক্ষেতলাল অফিসে জানতে আসলেন কেন? এই অপরাধে অফিসের ভিতরে অনেক লোকজনের সামনে লাঞ্ছিত করে পড়নের পাঞ্জাবি ছিড়ে ফেলে ঘাড় ধক্কা দিয়ে অফিস থেকে বের করে দেয়। ইউএনও, এসিল্যান্ডকে অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।”
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তহশিলদার মো. মোমিনুল হক বলেন, “ভাই, ভূমি অফিসে যারা চাকরী করে তাদের গায়ে গন্ধ লেগেই থাকে যা পারেন করেন।”
এ বিষয়ে সার্ভেয়ার কবির উদ্দিন বলেন, “আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ, কেউ প্রমাণ করতে পারবে না! কে যেন সেনাবাহিনীকে আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ দিয়েছিলেন। তারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো তদন্ত করে দেখুক।”
দৈনিক বাংলাদেশ সময়ের অনুসন্ধানে সার্ভেয়ার ও তহশিলদার মোমিনুলের অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের কিছু প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। এরপর তিনি নড়েচরে বসেন এবং এ বিষয়ে আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
ক্ষেতলাল উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জিনাতুল আরা দৈনিক বাংলাদেশ সময়কে বলেন, “এমন অভিযোগ আমি প্রথম শুনলাম। লিখিত অভিযোগ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জয়পুরহাট অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহা. সবুর আলীকে ক্ষেতলাল উপজেলা ভূমি অফিসের নানা অনিয়মের ভিডিও চিত্র, কলরের্কড, মোবাইলে ধারণকৃত স্থির চিত্র দেখানো হলে তিনি বলেন, “এমন প্রমাণসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”