তিস্তা নদী, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের জীবনরেখা হিসেবে পরিচিত। একসময় এই নদী উত্তরবঙ্গের কৃষি, পরিবহন ও জীববৈচিত্র্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাব ও বর্ষায় ভয়াবহ বন্যার কারণে এটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য একপ্রকার অভিশাপে পরিণত হয়েছে। নদীটির বর্তমান অবস্থার উন্নতি ঘটাতে বাংলাদেশ সরকার উচ্চাভিলাষী ‘তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প’ হাতে নিয়েছে।
এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য নদী ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ, কৃষি ও পরিবেশের টেকসই উন্নয়ন এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও বিদ্যমান রয়েছে। আন্তর্জাতিক পানি বণ্টন সমস্যা, নদীর প্রবাহ পুনরুদ্ধার, অর্থায়ন সংকট এবং বাস্তবায়ন পরিকল্পনার নিরবচ্ছিন্নতা—এসবই প্রকল্পের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যে রয়েছে।
বুধবার (১২ মার্চ) সকাল ১০টায় নীলফামারী জেলা প্রশাসন ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড নীলফামারীর আয়োজনে ‘তিস্তা নদীর সমন্বিত ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার’ শীর্ষক প্রস্তাবিত প্রকল্পের ওপর অংশীজনদের সাথে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সভায় সভাপতিত্ব করেন নীলফামারী জেলা প্রশাসক মোঃ নায়িরুজ্জামান। এছাড়াও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর অঞ্চল ডিভিশনের প্রধান প্রকৌশলীসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সভায় উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দও অংশ নেন।
সভায় তিস্তা নদীর বর্তমান অবস্থা, নদী ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। অংশগ্রহণকারীরা মতপ্রকাশ করেন যে, প্রকল্পটি যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে উত্তরাঞ্চলের কৃষি, জলজ সম্পদ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে।
তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে। এটি বাংলাদেশে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিলিত হয়েছে। একসময় এটি উত্তরাঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখত। তবে বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে, যার ফলে কৃষিকাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। অপরদিকে, বর্ষাকালে প্রচন্ড স্রোত ও অনিয়ন্ত্রিত প্রবাহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে।
পানি বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের তিস্তা ব্যারেজ ও অন্যান্য জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে নদীটির পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হচ্ছে। ১৯৮৩ সালে ভারতের গজলডোবা ব্যারেজ চালু হওয়ার পর থেকে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের অংশে তিস্তার প্রবাহ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। ফলে কৃষি, জীববৈচিত্র্য, ও স্থানীয় অর্থনীতির উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
কৃষি খাত: শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি না পাওয়ায় উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ফসল উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে।
জীববৈচিত্র্য: নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বন্ধ হওয়ায় তিস্তার মাছ ও জলজ প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।
ভূগর্ভস্থ পানির স্তর: নদীতে পর্যাপ্ত পানি না থাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও ক্রমশ নিচে নামছে।
বন্যা ও ভাঙন: বর্ষাকালে প্রচন্ড স্রোতের কারণে ব্যাপক বন্যা ও ভাঙনের সৃষ্টি হয়, যা হাজার হাজার মানুষকে গৃহহীন করছে।
তিস্তা নদী পুনরুদ্ধার প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ, যা বাস্তবায়িত হলে এই সংকট থেকে উত্তরাঞ্চলের মানুষ মুক্তি পেতে পারে। প্রকল্পটি মূলত তিনটি প্রধান স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে:
১. নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি ও পানি সংরক্ষণ: নদী খননের মাধ্যমে ৩৫০ মিলিয়ন ঘনমিটার পলি অপসারণ করা হবে, যা নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনবে। দীর্ঘমেয়াদী পানির সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে নদীর পাশে আধুনিক জলাধার নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। নদীর দুই তীর সংরক্ষণ ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে ভাঙন প্রতিরোধ করা হবে।
২. কৃষি ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন: নদীর আশপাশের ১০,২০০ হেক্টর জমি পুনরুদ্ধার করে চাষাবাদের জন্য উপযোগী করা হবে। ২০০,০০০ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করে কৃষিতে বিপ্লব ঘটানো হবে। নতুন কৃষি প্রকল্প, কোল্ড স্টোরেজ এবং কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
৩. পরিবেশ সংরক্ষণ ও পর্যটন বিকাশ: প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নদীর পানির প্রবাহ বজায় রেখে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ সম্ভব হবে। নদীর তীরবর্তী এলাকায় ইকো-ট্যুরিজম ও রিসোর্ট নির্মাণের মাধ্যমে পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটানো হবে।
তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্প বাংলাদেশের নদী রক্ষার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। সঠিক পরিকল্পনা, আন্তঃদেশীয় সহযোগিতা এবং কার্যকর বাস্তবায়নের মাধ্যমে এটি উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
নীলফামারীতে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভার আলোচনাগুলো এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের গুরুত্বকে আরও স্পষ্ট করেছে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে এটি শুধু উত্তরাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নেই ভূমিকা রাখবে না, বরং সারাদেশের জন্য একটি মডেল হতে পারে।