উন্নয়ন খাত থেকে রাজস্ব খাতে চাকরি স্থানান্তর নিয়ে জটিলতায় রাজশাহীর ৯টি উপজেলার ২৩২টি কমিউনিটি ক্লিনিকে কর্মরত স্বাস্থ্যকর্মীরা টানা ৮ মাস ধরে পায়নি বেতন-ভাতা। ফলে চরম আর্থিক সংকটে পড়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। এমনকি দ্রুত বেতন ভাতা না পেলে এই পেশা ছেড়ে জীবন জীবিকার তাগিদে অনেকেই বেছে নিতে হতে পারেন অন্য পেশা।
তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১৪ হাজার ৩ শ’ ২০টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ১৯৯৮ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক চালু হয়। সে বছর প্রকল্পের আওতায় সারাদেশে ১০ হাজার ৭৩২টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করা হয়।
পরবর্তীতে ২০০১ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ (কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প) এর আওতায় ২০০৯ সালে শীর্ষক ৫ বছর মেয়াদে উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়ে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়। ৫ বছর অতিবাহিত হলে ২০১৫ সালে ওপিতে যায়। ওপি থেকে ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাষ্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে।
রাজশাহীর নয়টি উপজেলায় মোট ২৩২টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। যার মধ্যে গোদাগাড়ী উপজেলায় ৩৪টি, চারঘাট উপজেলায় ২৩টি, বাঘা উপজেলায় ২০টি, পবা উপজেলায় ৩২টি, তানোর উপজেলায় ১৯টি, মোহনপুর উপজেলায় ১৯টি, দুর্গাপুর উপজেলায় ১৯টি, পুঠিয়া উপজেলায় ২৮টি, বাগমারা উপজেলায় ২০টি।
গোদাগাড়ী উপজেলার পিরিজপুর কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি) মোসা. রকিয়া খাতুন বলেন, আমরা প্রতিদিন শত শত রোগীকে সেবা দিচ্ছি। আগে বরাদ্দ আসলে দুই-এক মাস পর বা প্রতি মাসেই বেতন পেয়েছি। গত ৮ মাস থেকে কোনো বেতন পাইনি।
এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, ৮ মাস বেতন না পেলে সংসার নিয়ে কেমন থাকতে পারি? বলে তিনি বিস্ময়সূচক প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা প্রশ্ন করেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সিএইচসিপি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে সামান্য ওই বেতন দিয়ে টেনেটুনে কোনোরকমে সংসার চলতো। তারপর আবার গত ৮ মাস বেতন পাইনি। দোকানে বাকির টাকা বেশি হওয়ায় দোকানদাররা আর বাকিতে জিনিস দিচ্ছে না। কী যে বিপদে রয়েছি, কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। সংসারে খেয়ে না খেয়ে কোনো মতে দিনযাপন করছি। তারপরও রমজান মাস। কোনো হাট-বাজার করতে পারিনি। কি যে হয় আল্লাহ ভালো জানেন?
গোদাগাড়ী উপজেলা কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাদিকুল ইসলাম বলেন, টানা গত ৮ মাসেও হয়নি। এ কারণে জেলার ২৩২ জন হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। অনেকেই ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, পরিবারের অসুস্থ স্বজনদের চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনতে পারছেন না। বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আলম অন্তর বলেন, ট্রাস্ট ও রাজস্ব খাতের জটিলতার কারণে ৮ মাস ধরে বেতন-ভাতা পাইনি। হাইকোটে রিট করে ট্রাস্ট থেকে রাজস্ব খাতে যাওয়ার পক্ষে রায় হয়। আপিল করলে আপিলে ট্রাস্টের পক্ষে রায় হয়। ২০২৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর ট্রাস্টে যোগ হয়। বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। পরিবার পরিজন নিয়ে কষ্টে দিনতিপাত করছে। বেতন-ভাতা না পাওয়ায় স্বাস্থ্যকর্মীরা হতাশার মধ্যে থাকায় রোগীদের ঠিকমত স্বাস্থ্য সেবা দিতে পারছে না। ২০১১ সালে যারা কমিউনিটি ক্লিনিকে যোগদান করে ছিলেন তাদের সবার সরকারী বয়সসীমা শেষ হয়ে গেছে। এ নিয়েও তারা দুশ্চিন্তায় আছে। সরকারী বয়স শেষ হয়ে যাওয়ায় অন্য কোনো চাকরির সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। দ্রুত বকেয়া বেতন পরিশোধ করাসহ রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের জোর দাবি জানিয়েছেন মাহবুব আলম অন্তর।
রাজশাহী জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সিভিল সার্জন (ভারপ্রাপ্ত) ডক্টর মাহবুবা খাতুন বলেন, কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের জটিলতার কারণে সাত মাস ধরে বন্ধ আছে। বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবগত করা হয়েছে। দ্রুত সমাধানের চেষ্টা চলছে।
সচেতন মহল মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন ভাতা দ্রুত পরিশোধসহ সমস্যা সমাধান করা না হলে ভেঙ্গে পড়বে গ্রামীণ স্বাস্থ্য সেবা। স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হবে গ্রামের অসহায় দরিদ্র সহজ-সরল মানুষগুলো।