নওগাঁর বদলগাছীতে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত দুস্থ মহিলা উন্নয়ন (ভিজিডি) নতুন নাম ভালনারেবল উইমেন বেনিফিটের (ভিডব্লিউবি) আওতাধীন গরীব, অসহায় ও দুস্থ ২৬১ জন উপকারভোগীর দুই বছরের জমানো সঞ্চয়ের প্রায় ১৩ লক্ষ ৭৮ হাজার ৮০ টাকা নিয়ে লাপাত্তা পাহাড়পুর ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটার সেন্টারের উদ্যোক্তা দুলাল হোসেন ও তার স্ত্রী সুইটি বেগম।
দুলাল হোসেন ও দুলালের স্ত্রী সুইটি বেগম পাহাড়পুর ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারের উদ্যোক্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। দুলাল হোসেন একই ইউনিয়নের গোয়ালভিটা গ্রামের সুজাউলের ছেলে।
জানা যায়, পাহাড়পুর ইউনিয়নের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর পরিচালিত দুস্থ মহিলা উন্নয়ন (ভিজিডি) নতুন নাম ভালনারেবল উইমেন বেনিফিটের (ভিডব্লিউবি) আওতাধীন ২৬১ জন গরীব, অসহায় ও দুস্থ উপকারভোগীর দুই বছরের জমানো সঞ্চয়ের টাকা উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত শিডিউল মোতাবেক গত (রবিবার) ২৬ জানুয়ারি থেকে মঙ্গলবার (২৮ জানুয়ারি) তারিখের মধ্যে উপকারভোগীদের ফেরত দেওয়ার জন্য পরিষদে একটি চিঠি দেন।
টাকা ফেরতের তারিখ জানতে পেরেই গত শুক্রবার (২৪শে জানুয়ারি) সন্ধ্যায় উদ্যেক্তা বাড়িতে যায় এবং শনিবার (২৫ জানুয়ারি) সকাল থেকেই ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারটি বন্ধ পাওয়া যায়। উদ্যেক্তা দুলাল হোসেনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।
এ বিষয়ে পাহাড়পুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান কিশোর গত সোমবার (২৭ জানুয়ারি) উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বরাবর একটি অভিযোগ দিয়েছেন।
ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, এর আগে উপকারভোগীদের সঞ্চয়ের টাকা জমা হতো ডাচবাংলা এজেন্ট ব্যাংকে। পরে বদলগাছী উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের সকল উদ্যেক্তারা উপজেলার ইউএনওর সাথে আলোচনা করে বলেছে আমরা ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টারে কাজ করি আমাদেরও এজেন্ট ব্যাংকিং আছে। আমরা যদি উপকারভোগীদের প্রতি মাসের সঞ্চয়ের টাকাগুলো জমা করতাম তাহলে আমরা কিছু লাভবান হতাম। সেই কথা বিবেচনা করে ইউএনওর অনুমতি নিয়ে এবং তার নির্দেশনায় উদ্যেক্তাদের যে ব্যাংকে এজেন্ট আছে সেই এজেন্ট ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে বলে। উদ্যোক্তা দুলাল হোসেন এনআরবিসি ব্যাংকের এজেন্ট ছিলেন সে ওখানে টাকা জমা দিয়ে আসতো বলে জেনেছি।
আরও জানা যায়, দুলাল হোসেন উপকারভোগীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে সঞ্চয়ের টাকা জমা নিয়ে কার্ডে লিখে দিতো। আর সেই কার্ড দেখে আমরা চাল দিতাম। এই ইউনিয়নে মোট ২৬১ জন ভিজিডির উপকারভোগী আছে। তারা প্রতি মাসে একেকজন ২২০ টাকা করে জমা রাখতো। সেই মোতাবেক দুই বছরে জন প্রতি জমা হয়েছিল ৫২৮০ টাকা। ২৬১ জন উপকারভোগীর জমাকৃত মোট টাকার পরিমাণ ১৩ লাক্ষ ৭৮ হাজার ৮০ টাকা। আর এই টাকা ফেরত দিতে হবে সেই খবর পেয়েই গত ২৪ জানুয়ারি রাত থেকে তাঁরা নিখোঁজ হয়।
সরেজমিনে বদলগাছীর পাহাড়পুর ইউনিয়ন পরিষদে গিয়ে দেখা যায়, ইউনিয়নের ডিজিটাল ইনফরমেশন সেন্টারটি (তথ্য সেবাকেন্দ্র) বন্ধ রয়েছে।
বন্ধের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয়রা জানান, গত ২৫ জানুয়ারি থেকে উদ্যেক্তা এই ঘর খোলেনি, এখনো পর্যন্ত বন্ধ রয়েছে। আমরা শুনেছি যে উপকারভোগীদের জমানো টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছে।
আরো জানান, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান কিশোরের কাছের মানুষ হওয়ায় উদ্যোক্তা দুলাল হোসেন ও তার স্ত্রী সুইটি বেগমের কোনো কাজই তদারকি করেন না ইউনিয়ন পরিষদ সচিব ও উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদ। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইউনিয়নের ২৬১ জন দুস্থ, গরীব, অসহায় মহিলা উপকারভোগীর জমা করা টাকা উপকারভোগীদের নিজস্ব একাউন্টে জমা না করে আত্মসাৎ করেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, উদ্যোক্তা দুলাল আর ওই যে চিংকু মেম্বার আছে না। চিংকু মানে বললে, চিংকু মানে করিম। ওর নাম করিম, করিম উদ্দিন চয়েন। ওদের বাড়ি পাশাপাশি। এতে চেয়ারম্যানও জড়িত আছে। চেয়ারম্যান ও মেম্বারগুলা এদের হাতে আছে।
উদ্যোক্তার বিষয়ে পাহাড়পুর ইউপি সদস্য করিম উদ্দিন চয়েন বলেন, ২৬১ জনের টাকা নিয়ে পালায়ে গেছে। সব বইয়ের ফটোকপি নিয়ে গেলে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার মাধ্যমে সঠিক তথ্য জানাতে পারবো।
কিছু এলাকাবাসীর অভিযোগ যে আপনি ঐ ছেলেকে পালাতে সাহায্য করেছেন বলে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, যদি কেউ বলে, এডা ডাসা মিথ্যা কথা। একবারে মিথ্যা কথা। আমার সাথে তার কোনো ঐ রকম অফিসিয়ালভাবে সম্পর্ক নাই। আমি কেন তাকে সাহায্য করবো? আমার স্বার্থ কোথায়? এটা হল বড় বিষয়। যদি এটা কেউ বলে তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও হিংসামূলক। আমার যে রাজনৈতিক কারিয়ার আছে এটা ক্ষুণ্ণ করার জন্য তারা বলতে পারে।
বদলগাছী এনআরবিসি ব্যাংক সূত্র জানায়, পাহাড়পুর ইউনিয়নের ভিজিডির আওতাধীন দুইশ’র মতো ব্যাংকে একাউন্ট আছে। এই একাউন্টগুলোতে নামমাত্র টাকা জমা আছে যা একাউন্ট খোলার সময় রাখা হয়েছিল।
ব্যাংকে টাকা জমা হচ্ছে কি না এর তদারকি বিষয়ে জানতে চাইলে পাহাড়পুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব কাজী শাহাব উদ্দীন বলেন, আগে ঐভাবে কখনো প্রয়োজন পড়েনি। এর আগে প্রথমে এনজিও ও মহিলা বিষয়কের যৌথ স্বাক্ষরে একাউন্ট থাকতো, আর সেই একাউন্টে উপকারভোগীদের সঞ্চয়ের টাকা জমা হতো । তখন এনজিও লোক এসে সরাসরি টাকা নিতো। যার কারণে ঐভাবে তদারকি করা হয় না। আমরা শুধু দেখি সঞ্চয় দিচ্ছে কিনা, গ্রাহকরা সঞ্চয় দিয়ে চাল নিচ্ছে কিনা। ইউএনও স্যারের নির্দেশনায় ব্যাংক যেহেতু এজেন্ট দিয়ে দিয়েছে। সে ব্যাংকে কখন টাকা জমা করেছে সেটা জানিনা।
উদ্যোক্তা কত টাকা নিয়ে পালিয়েছে বলে জানতে চাইলে পাহাড়পুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান কিশোর বলেন, ৭ থেকে ৮ লাখ হবে। আর ২৬১ জন সবাই তো প্রতি মাসে টাকা দেয়নি। প্রতি মাসে উপকারভোগীদের জনপ্রতি ২২০ টাকা করে জমা রাখার কথা ছিল। টাকা নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে ইউএনওর কাছে একটি দরখাস্ত করা হয়েছে। এখনো মনে হয় মামলা রেকর্ড হয়নি।
জানতে চাইলে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা ফারুক আহম্মেদ বলেন, উপকারভোগীদের কাছ থেকে টাকা জমা নিয়ে লেখে দেয় উদ্যোক্তা, ২২০ টাকা করে। আর জমার সেই কার্ড দেখে পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা চাল বিতরণ করে। আমরা শুনেছিলাম প্রত্যেক মহিলার নামে আলাদা আলাদা একাউন্ট খোলা আছে। আমরা ব্যাংকে তথ্য নিলাম ২০৩/২০৪টা একাউন্ট রয়েছে। আমরা যখন উপকারভোগীদের জমানো টাকা তাদের মাঝে বিতরণের জন্য পরিষদকে চিঠি দিলাম ঐ সময়ও যোগাযোগ সব ঠিক ছিল। ২৬ তারিখে গিয়ে দেখা গেলো সে নাই।
উপকারভোগীদের নামে ব্যাংকে টাকা জমা হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে তদারকি ও খোঁজ নেবার দ্বায়িত্ব তো আপনার বলে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, উদ্যোক্তা চেয়ারম্যানের আপন লোক। আর চেয়ারম্যানের আপন লোক ছাড়া প্রতিটা ইউনিয়ন পরিষদে উদ্যোক্তা কমই আছে। তাই সেই ভাবে কোনো খোঁজ-খবর নেওয়া হয়নি। এজন্য আমি দুঃখিত।
বদলগাছী থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শাহজাহান আলী বলেন, এবিষয়ে একটি অভিযোগ হয়েছে। ওকে ধরার জন্য লোক পাঠায়ছিলাম। শুনলাম সে নাকি বাহিরে চলে গেছে। এখনো মামলা হয়নি। এ বিষয়ে বদলগাছী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ইসরাত জাহান ছনি জানান, এ ব্যাপারে থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছি এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে।