বাংলাদেশ সরকার প্রতি বছর সিগারেট ও বিড়ির ওপর ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধি করে, ধূমপান নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি রাজস্ব আয় বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে। তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কিছু কোম্পানি এবং এজেন্ট পুরনো ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে নতুন দামে সিগারেট বিক্রি করছে, যা সরকারকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে এবং ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। অন্যদিকে, বিড়ি শিল্পেও ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে, যেখানে ক্ষুদ্র বিড়ি কারখানাগুলো কর ফাঁকি দিচ্ছে এবং কাস্টমস কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় জাল ব্যান্ডরোল ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভ্যাট বৃদ্ধির পরও পুরনো ব্যান্ডরোলের সিগারেট বেশি দামে কেন?
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সরকার নতুন ভ্যাট হার কার্যকর করলেও, অনুসন্ধানে দেখা গেছে বাজারে এখনো পুরনো ব্যান্ডরোল যুক্ত সিগারেট নতুন দামে বিক্রি হচ্ছে। এর ফলে, সরকার নির্ধারিত নতুন ভ্যাট আদায় হচ্ছে না, অথচ ভোক্তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য নেওয়া হচ্ছে।
মূল অনিয়ম:
গোল্ডলিফ, বেনসন, লাকি, ডারবি, স্টার, রয়েল ব্র্যান্ডের সিগারেট নতুন দামে বিক্রি হচ্ছে, যেখানে ব্যান্ডরোল পুরনো।
এতে প্রতি প্যাকেটে ১০-৪০ টাকা বেশি নেওয়া হচ্ছে, যা সরাসরি ব্যবসায়ীদের লাভ এবং সরকারকে ফাঁকি।
কাস্টমস বা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর এখনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।
সরকারি তদন্তের অনুপস্থিতি:
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাস্টমস বিভাগ এখনো এ বিষয়ে কোনো বিশেষ তদন্ত বা অভিযানের ঘোষণা দেয়নি। কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করতে চাইলে, তারা কোনো তথ্য দেননি।
বিদেশি কোম্পানির এজেন্টদের ভূমিকা ও রাজস্ব ফাঁকি:
অনেক আন্তর্জাতিক সিগারেট কোম্পানির বাংলাদেশি এজেন্টরা এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। তারা পুরনো ব্যান্ডরোল লাগিয়ে বেশি দামে সিগারেট বিক্রি করে, যাতে সরকারের নির্ধারিত অতিরিক্ত ভ্যাট সরকার না পায়। বিদেশি কোম্পানির রংপুর অঞ্চলের এজেন্ট শাইরিন এন্টারপ্রাইজ এর ম্যানেজার শোয়েব আহমেদের সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
কিভাবে এটি সম্ভব হচ্ছে?
মজুতকৃত পুরনো ব্যান্ডরোলের সিগারেট নতুন দামে বাজারে ছাড়ছে।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নজরদারি এড়িয়ে যাচ্ছে।
অনেকে সরকারকে কর দেখানোর জন্য নথিতে কম বিক্রির তথ্য দিচ্ছে।
সরকার কিভাবে প্রতিরোধ করতে পারে?
হঠাৎ অভিযান চালানো ও ব্যবসায়ীদের কাছে হালনাগাদ ব্যান্ডরোলের হিসাব চাওয়া।
ই-ভ্যাট চালানের বাধ্যবাধকতা তৈরি করা, যাতে সব বিক্রি ট্র্যাক করা যায়।
ভোক্তাদের অভিযোগ জানানোর জন্য একটি হটলাইন চালু করা।
বিড়ি শিল্পে কর ফাঁকি ও কাস্টমসের দুর্নীতি:
রংপুর অঞ্চলে ছোট-বড় ২০০-এর বেশি বিড়ি ফ্যাক্টরি আছে, যাদের বেশিরভাগই কর ফাঁকি দেয়।
কিভাবে বিড়ি শিল্পে কর ফাঁকি হচ্ছে?
উৎপাদন কম দেখিয়ে কম ব্যান্ডরোল সংগ্রহ করা।
জাল ব্যান্ডরোল তৈরি করে কমদামে বিড়ি বিক্রি করা।
কাস্টমসের কিছু কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়ে অনিয়ম চালিয়ে যাওয়া।
অভিযোগ:
বিড়ি মালিকরা কাস্টমস অফিসে মাসোয়ারা দেয়।
সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করতে গেলে, মালিকরা কেউ কথা বলতে রাজি হয় না।
সরকার কি করতে পারে?
নিয়মিত অভিযান ও জাল ব্যান্ডরোল শনাক্ত করা।
অবৈধ বিড়ি ফ্যাক্টরি বন্ধ করা।
সঠিক কর আদায় নিশ্চিত করতে ডিজিটাল ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা।
কাস্টমস অফিসের অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতি:
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কাস্টমস বিভাগ তথ্য গোপন করছে এবং সাংবাদিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চায় না।
মূল সমস্যা:
তথ্য অধিকার আইনের চিঠির কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি।
কাস্টমস ওয়েবসাইটেও স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশ করা হয় না।
সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কর্মকর্তার দেখা করতে অনীহা।
ভ্যাট অফিসে দুর্নীতি:
হোটেল-রেস্তোরাঁর ভ্যাট জমা দিতে গেলে, ব্যবসায়ীদেরকে চালানের বিপরীতে অফিস খরচের নামে সমান অঙ্কের টাকা দিতে হয়। টাকা না দিলে, ভ্যাট ফাঁকি দেওয়ার কথা বলে হয়রানি করা হয়। আমরা যেসব মালিকদের সাথে কথা বলেছি, তারা সবাই আমাদের সাথে কথা বলেছেন ভয়ে ভয়ে। আর নাম প্রকাশ না করার শর্তে।
অতিরিক্ত নিয়োগ:
রংপুর কাস্টমস অফিসে ১১টি গাড়ি থাকলেও, ড্রাইভার ২৮ জন।
প্রশ্ন ওঠে, এত ড্রাইভার কীভাবে প্রয়োজনীয়?
দুর্নীতি ঢাকতে তথ্য গোপন:
সাংবাদিকদের তরফে তথ্য অধিকার আইনে চিঠি দেয়ার পর কাস্টমসের কর্মকর্তারা ঘুষের রাজকীয় খাবারের আয়োজন সরিয়ে পাশের বাড়িতে রান্না ও টিফিন বাটির মাধ্যমে স্টাফদের খাবার সরবরাহ করছেন।
এটি তথ্য গোপনের কৌশল এবং দুর্নীতি ঢাকার চেষ্টা।
উপসংহার:
সরকারের নতুন ভ্যাট নীতির কারণে, সিগারেট ও বিড়ি শিল্পে কর ফাঁকি ও অনিয়ম বাড়ছে।
সিগারেটের পুরনো ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে বেশি দামে বিক্রির ফলে, সরকার ও জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বিড়ি শিল্পে কর ফাঁকি নতুন নয়, তবে কাস্টমস কর্মকর্তাদের দুর্নীতি এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করছে।
কাস্টমস বিভাগ সাংবাদিকদের তথ্য না দিয়ে উল্টো অনিয়ম ঢাকতে চেষ্টা করছে।
প্রশ্ন থেকে যায়:
কর্তৃপক্ষ কি এবার কার্যকর অভিযান চালাবে?
কাস্টমস ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর কি পুরনো ব্যান্ডরোল ব্যবহার করে, নতুন দামে বিক্রি করা সিগারেটের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নেবে?
জনগণের করের টাকা কি আবারো দুর্নীতির কবলে পড়বে?