ঢাকা ০৫:৫৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
এই মাত্র পাওয়াঃ
সংবাদ শিরোনামঃ
সাবেক মেয়র তাপসকে দুদকে তলব দুর্নীতির অভিযোগে ডিবি হারুন ও তার পরিবারকে দুদকে তলব দুর্নীতির অভিযোগে দুই যুগ্ম সচিবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যবিপ্রবিরএডি আব্দুর রশিদের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী নির্যাতন ও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে লন্ডনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন সাইফুজ্জামান রাজস্ব পরিদর্শক খায়রুল হাসান নিপু’র বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ মেয়র আতিকের এপিএস ফরিদের ভাই ফারুকের বিরুদ্ধে হুন্ডি ও অর্থপাচারের অভিযোগ মৌলভীবাজারের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, কাজ না করে বিল উত্তোলন উপ-সহকারী প্রকৌশলীর দুদকের জালে সাবেক মন্ত্রী কামরুল ইসলাম অবশেষে দুর্নীতিপরায়ন স্থানীয় সরকার সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান ওএসডি

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ নিয়ে বড়সাংবিধানিক সংকটের মুখে দেশ

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজেই পদত্যাগের দাবির মুখে পড়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তার পদত্যাগসহ বেশ কিছু দাবিতে বঙ্গভবনসহ বিভিন্ন এলাকায় দাবি আদায়ে আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন।

অভিযোগ উঠেছে রাষ্ট্রপতির শপথ ভঙ্গেরও। তবে স্পিকার পদত্যাগ করায় রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন তা নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় সাংবিধানিক প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের বিষয়ে দেশ বড় ধরনের সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন আইন বিশ্লেষকরা।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। গত ৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাকে শপথ পড়ান।

সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেন, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই।

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) হয়তো সময় পাননি।’

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনার লিখিত পদত্যাগপত্র না পাওয়ার কথা বললে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তার বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক ছাত্ররা এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন।

এই দাবিতে ২২ অক্টোবর শহীদ মিনারে সমাবেশ ও বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের চেষ্টা করা হয়। তারা রাষ্ট্রপতিকে পদ ছাড়তে আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এর মধ্যে পদত্যাগ না করলে তারা বঙ্গভবন ঘেরাওসহ আন্দোলন গড়ে তুলবেন বলে জানিয়েছেন।

এদিকে রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের বিষয়ে সংবিধানের ৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করা যাবে। এর জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে অনুরূপ অভিযোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে প্রদান করতে হবে।

স্পিকারের কাছে অনুরূপ নোটিশ প্রদানের দিন থেকে ১৪ দিনের আগে বা ৩০ দিনের পর এই প্রস্তাব আলোচিত হতে পারবে না এবং সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে স্পিকার অবিলম্বে সংসদ আহ্বান করবেন এবং (৪) উপ-অনুচ্ছেদ মোতাবেক, অভিযোগ-বিবেচনার পর মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অভিযোগ যথার্থ বলে ঘোষণা করে সংসদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করলে, প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার তারিখে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।’

এছাড়া সংবিধানের ৫৩(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে অপসারিত করা যাবে। এর জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে কথিত অসামর্থ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের নিকট প্রদান করা এবং উপ-অনুচ্ছেদ (২) অনুসারে সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে নোটিশ প্রাপ্তিমাত্র স্পিকার সংসদের অধিবেশন আহ্বানের বিধান রয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে পারবেন কিনা, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। যেহেতু স্পিকার পদত্যাগ করেছে, সেহেতু সংবিধানের ৭৪(৬) অনুসারে স্পিকারের পদত্যাগ সত্ত্বেও তিনি স্পিকার থেকে যাবেন এবং রাষ্ট্রপতির সব কর্মকাণ্ড স্পিকারের ওপর ন্যস্ত হবে। তবু সংবিধানের দু’টো অনুচ্ছেদ জরুরি, অনুচ্ছেদ ৭৪(৬) এবং অনুচ্ছেদ ৫৪।

সংবিধানের পঞ্চম ভাগে আইনসভা অংশে অনুচ্ছেদ ৭৪(৬)-এ বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলি সত্ত্বেও ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে। আর (২) দফায় বলা হয়েছে, স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের পদ শূন্য হবে, যদি (ক) তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন; (খ) তিনি মন্ত্রী-পদ গ্রহণ করেন; (গ) পদ হতে তার অপসারণ দাবি করে মোট সংসদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সমর্থিত কোনো প্রস্তাব (প্রস্তাবটি উত্থাপনের অভিপ্রায় জ্ঞাপন করে অন্যূন ১৪ দিনের নোটিশ প্রদানের পর সংসদে গৃহীত হয়; (ঘ) তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে তার পদ ত্যাগ করেন; (ঙ) কোনও সাধারণ নির্বাচনের পর অন্য কোনও সদস্য তার কার্যভার গ্রহণ করেন; অথবা (চ) ডেপুটি স্পিকারের ক্ষেত্রে তিনি স্পিকারের পদে যোগদান করেন।’

আর সংবিধানের চতুর্থ ভাগে নির্বাহী বিভাগ অংশে অনুচ্ছেদ ৫৪-তে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ্য হলে ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।’ তাহলে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হবে কীভাবে তার জবাবে আহসানুল করিম বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হয় না।রাষ্ট্রপতি শুধু সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে থাকেন।

সংবিধানে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ সম্পর্কে ৪৮(১) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের কর্তৃক নির্বাচিত হবেন।

প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে কিনা প্রশ্নে আহসানুল করিম বলেন, ‘কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিচার বিভাগ একটি আলাদা বিভাগ। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রধান বিচারপতিকেও দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির হাতে নেই, তা বলার মাধ্যম দু’টো বিষয় হয়েছে। প্রথমত, শুধু সংবিধানের অধীনে দায়িত্ব পালনের জন্য নয়, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্যও রাষ্ট্রপতি শপথ নিয়ে থাকেন। তাহলে আমি মনে করি, তিনি সেই শপথ রক্ষা করতে পারেনি এবং দ্বিতীয়ত. তার সাক্ষাৎকারের পর বিভিন্ন দল ও বঙ্গভবনের সামনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তখন তিনি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন এটি মীমাংসিত বিষয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তিনি তা গ্রহণ করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। আমি মনে করি, এই পরিস্থিতিতে তিনি তার শপথ থেকেও বিচ্যুত হয়েছেন।’

স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, এখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে নতুন রাষ্ট্রপতি কার কাছে শপথ পড়বেন জানতে চাইলে এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, ‘আইন দিয়ে সবসময় সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায় না। ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তখন কিন্তু আমাদের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল না। ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের সর্বসম্মতির ভিত্তিতে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমি রাজি আছি, যদি নির্বাচন শেষে আমাকে স্বপদে (প্রধান বিচারপতি) ফিরিয়ে আনা হয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে তিনি মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে আবারও স্বপদে ফিরে এসেছিলেন।

এবার ফিরে আসি সাম্প্রতিক ঘটনায়। ৫ আগস্টের পর সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমাদের সুপ্রিম কোর্ট একটি উপদেশমূলক পরামর্শ দিয়েছিল। যার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করছে। পরে রাষ্ট্রপতি এই সরকারের বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করেছেন। ফলে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন সেটি বড় কথা না। তিনি নিজ থেকেই পদত্যাগ করতে পারেন। এজন্য কারো কাছে পদত্যাগ করার প্রয়োজন নেই, যখন এমন অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। কেউ নেই এটা বলার সুযোগ নেই। কারণ যখন সংসদ নেই, মন্ত্রিসভা নেই, এমন একটি সময়ে কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়েছে। ডকট্রিন অব নেসেসিটি অর্থাৎ সময়ের প্রয়োজন সবকিছু পূর্ণ করে দেবে। এখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে আবারও সুপ্রিম কোর্টের কাছে পরামর্শ চাইতে পারে বলেও আমি মনে করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে আইনের এইরূপ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করতে পারবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করতে পারবেন। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের কাছে রাষ্ট্রপতি পরামর্শ চাইতে পারবেন বলে উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কে সেই পরামর্শ চাইবেন এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘দেশে সাংবিধানিক সংকট চলছে। কেননা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যে বৈধতা দেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিকভাবে হয়নি।’

জনপ্রিয় সংবাদ

মাগুরায় শুরু হয়েছে ঐতিহ্যবাহী কাত্যানী পূজা

রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ নিয়ে বড়সাংবিধানিক সংকটের মুখে দেশ

আপডেট সময় ০২:৪৯:১৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৪

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র ইস্যুতে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিজেই পদত্যাগের দাবির মুখে পড়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা তার পদত্যাগসহ বেশ কিছু দাবিতে বঙ্গভবনসহ বিভিন্ন এলাকায় দাবি আদায়ে আল্টিমেটাম দিয়ে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন।

অভিযোগ উঠেছে রাষ্ট্রপতির শপথ ভঙ্গেরও। তবে স্পিকার পদত্যাগ করায় রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন তা নিয়ে দেখা দিয়েছে বড় সাংবিধানিক প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগের বিষয়ে দেশ বড় ধরনের সাংবিধানিক সংকটের মুখে পড়বে বলে মনে করছেন আইন বিশ্লেষকরা।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মো. সাহাবুদ্দিন। গত ৫ আগস্ট সরকারের পতন হলে রাষ্ট্রপতি জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং ৮ আগস্ট অন্তর্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং অন্যান্য উপদেষ্টাকে শপথ পড়ান।

সম্প্রতি দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেন, তিনি শুনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই।

রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) হয়তো সময় পাননি।’

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শেখ হাসিনার লিখিত পদত্যাগপত্র না পাওয়ার কথা বললে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল তার বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের সমর্থক ছাত্ররা এরই মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে ‘ফ্যাসিবাদের দোসর’ বলে তার পদত্যাগ দাবি করেছেন।

এই দাবিতে ২২ অক্টোবর শহীদ মিনারে সমাবেশ ও বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের চেষ্টা করা হয়। তারা রাষ্ট্রপতিকে পদ ছাড়তে আল্টিমেটাম দিয়েছেন। এর মধ্যে পদত্যাগ না করলে তারা বঙ্গভবন ঘেরাওসহ আন্দোলন গড়ে তুলবেন বলে জানিয়েছেন।

এদিকে রাষ্ট্রপতির অভিশংসনের বিষয়ে সংবিধানের ৫২(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করা যাবে। এর জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে অনুরূপ অভিযোগের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে প্রদান করতে হবে।

স্পিকারের কাছে অনুরূপ নোটিশ প্রদানের দিন থেকে ১৪ দিনের আগে বা ৩০ দিনের পর এই প্রস্তাব আলোচিত হতে পারবে না এবং সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে স্পিকার অবিলম্বে সংসদ আহ্বান করবেন এবং (৪) উপ-অনুচ্ছেদ মোতাবেক, অভিযোগ-বিবেচনার পর মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অভিযোগ যথার্থ বলে ঘোষণা করে সংসদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করলে, প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার তারিখে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হবে।’

এছাড়া সংবিধানের ৫৩(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে, ‘শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যের কারণে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে অপসারিত করা যাবে। এর জন্য সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষরে কথিত অসামর্থ্যের বিবরণ লিপিবদ্ধ করে একটি প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের নিকট প্রদান করা এবং উপ-অনুচ্ছেদ (২) অনুসারে সংসদ অধিবেশনরত না থাকলে নোটিশ প্রাপ্তিমাত্র স্পিকার সংসদের অধিবেশন আহ্বানের বিধান রয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে পারবেন কিনা, সে বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করতে চাইলে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। যেহেতু স্পিকার পদত্যাগ করেছে, সেহেতু সংবিধানের ৭৪(৬) অনুসারে স্পিকারের পদত্যাগ সত্ত্বেও তিনি স্পিকার থেকে যাবেন এবং রাষ্ট্রপতির সব কর্মকাণ্ড স্পিকারের ওপর ন্যস্ত হবে। তবু সংবিধানের দু’টো অনুচ্ছেদ জরুরি, অনুচ্ছেদ ৭৪(৬) এবং অনুচ্ছেদ ৫৪।

সংবিধানের পঞ্চম ভাগে আইনসভা অংশে অনুচ্ছেদ ৭৪(৬)-এ বলা হয়েছে, ‘এই অনুচ্ছেদের (২) দফার বিধানাবলি সত্ত্বেও ক্ষেত্রমত স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকার তার উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল রয়েছেন বলে গণ্য হবে। আর (২) দফায় বলা হয়েছে, স্পিকার বা ডেপুটি স্পিকারের পদ শূন্য হবে, যদি (ক) তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন; (খ) তিনি মন্ত্রী-পদ গ্রহণ করেন; (গ) পদ হতে তার অপসারণ দাবি করে মোট সংসদ সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সমর্থিত কোনো প্রস্তাব (প্রস্তাবটি উত্থাপনের অভিপ্রায় জ্ঞাপন করে অন্যূন ১৪ দিনের নোটিশ প্রদানের পর সংসদে গৃহীত হয়; (ঘ) তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে তার পদ ত্যাগ করেন; (ঙ) কোনও সাধারণ নির্বাচনের পর অন্য কোনও সদস্য তার কার্যভার গ্রহণ করেন; অথবা (চ) ডেপুটি স্পিকারের ক্ষেত্রে তিনি স্পিকারের পদে যোগদান করেন।’

আর সংবিধানের চতুর্থ ভাগে নির্বাহী বিভাগ অংশে অনুচ্ছেদ ৫৪-তে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব পালনে অসমর্থ্য হলে ক্ষেত্রমতো রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত কিংবা রাষ্ট্রপতি পুনরায় স্বীয় কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন।’ তাহলে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হবে কীভাবে তার জবাবে আহসানুল করিম বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি নিয়োগ হয় না।রাষ্ট্রপতি শুধু সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে নিয়োগ পেয়ে থাকেন।

সংবিধানে রাষ্ট্রপতি নিয়োগ সম্পর্কে ৪৮(১) অনুচ্ছেদ বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের কর্তৃক নির্বাচিত হবেন।

প্রধান বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে কিনা প্রশ্নে আহসানুল করিম বলেন, ‘কোনো সুযোগ নেই। কারণ বিচার বিভাগ একটি আলাদা বিভাগ। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা প্রধান বিচারপতিকেও দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র রাষ্ট্রপতির হাতে নেই, তা বলার মাধ্যম দু’টো বিষয় হয়েছে। প্রথমত, শুধু সংবিধানের অধীনে দায়িত্ব পালনের জন্য নয়, রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্যও রাষ্ট্রপতি শপথ নিয়ে থাকেন। তাহলে আমি মনে করি, তিনি সেই শপথ রক্ষা করতে পারেনি এবং দ্বিতীয়ত. তার সাক্ষাৎকারের পর বিভিন্ন দল ও বঙ্গভবনের সামনে যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তখন তিনি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন এটি মীমাংসিত বিষয় প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তিনি তা গ্রহণ করেছেন এবং পরবর্তী সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। আমি মনে করি, এই পরিস্থিতিতে তিনি তার শপথ থেকেও বিচ্যুত হয়েছেন।’

স্পিকার পদত্যাগ করেছেন, এখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে নতুন রাষ্ট্রপতি কার কাছে শপথ পড়বেন জানতে চাইলে এই জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, ‘আইন দিয়ে সবসময় সব পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যায় না। ১৯৯১ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল তখন কিন্তু আমাদের সংবিধানে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছিল না। ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের সর্বসম্মতির ভিত্তিতে তৎকালীন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তখন মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন, এই নির্বাচন অনুষ্ঠানে আমি রাজি আছি, যদি নির্বাচন শেষে আমাকে স্বপদে (প্রধান বিচারপতি) ফিরিয়ে আনা হয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে তিনি মো. সাহাবুদ্দিন আহমেদ রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করে আবারও স্বপদে ফিরে এসেছিলেন।

এবার ফিরে আসি সাম্প্রতিক ঘটনায়। ৫ আগস্টের পর সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আমাদের সুপ্রিম কোর্ট একটি উপদেশমূলক পরামর্শ দিয়েছিল। যার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাজ করছে। পরে রাষ্ট্রপতি এই সরকারের বিষয়ে অধ্যাদেশ জারি করেছেন। ফলে রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন সেটি বড় কথা না। তিনি নিজ থেকেই পদত্যাগ করতে পারেন। এজন্য কারো কাছে পদত্যাগ করার প্রয়োজন নেই, যখন এমন অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি হয়। কেউ নেই এটা বলার সুযোগ নেই। কারণ যখন সংসদ নেই, মন্ত্রিসভা নেই, এমন একটি সময়ে কিন্তু বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়েছে। ডকট্রিন অব নেসেসিটি অর্থাৎ সময়ের প্রয়োজন সবকিছু পূর্ণ করে দেবে। এখন রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে আবারও সুপ্রিম কোর্টের কাছে পরামর্শ চাইতে পারে বলেও আমি মনে করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যদি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির নিকট প্রতীয়মান হয় যে আইনের এইরূপ কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে বা উত্থাপনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে, যা এমন ধরনের ও এমন জনগুরুত্বসম্পন্ন যে, সেই সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাহলে তিনি প্রশ্নটি আপিল বিভাগের বিবেচনার জন্য প্রেরণ করতে পারবেন এবং উক্ত বিভাগ স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত শুনানির পর প্রশ্নটি সম্পর্কে রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় মতামত জ্ঞাপন করতে পারবেন। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের কাছে রাষ্ট্রপতি পরামর্শ চাইতে পারবেন বলে উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে কে সেই পরামর্শ চাইবেন এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা বলেন, ‘দেশে সাংবিধানিক সংকট চলছে। কেননা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যে বৈধতা দেওয়া হয়েছে তা পুরোপুরি সঠিকভাবে হয়নি।’