বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির দাবির মুখে দেশের অন্যতম ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
বুধবার (২৩ অক্টোবর) রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা প্রজ্ঞাপনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০০৯-এর ক্ষমতাবলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে ছাত্রলীগকে এই আইনের তফসিল-২ অনুসারে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ছাত্রলীগের সদস্যরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা–পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে, বিশেষ করে বিগত ১৫ বছর ধরে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল। এ সময়ের মধ্যে হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, গণরুমকেন্দ্রিক নিপীড়ন, সিট বাণিজ্য এবং টেন্ডারবাজির মতো নানা অভিযোগে ছাত্রলীগের নাম বারবার উঠে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে সংগঠনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোকে নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে, যেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন এবং আন্দোলনকারীদের দাবি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিল। ২৩ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেয় যে, ছাত্রলীগকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে নিষিদ্ধ না করা হলে তারা কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিবে। সেই প্রেক্ষাপটে বুধবার সন্ধ্যায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তাদের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
ছাত্রলীগের সহিংস কর্মকাণ্ড এবং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
বিগত ১৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের সদস্যরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনগণের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে শত শত নিরীহ মানুষ নিহত হন এবং আরও অসংখ্য মানুষ আহত হন। সরকারের প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, ছাত্রলীগের সহিংসতার কারণে শিক্ষার্থী এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যা সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশকে ব্যাহত করে। এরই প্রেক্ষিতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।
সরকার আরও জানায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরও ছাত্রলীগ রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রমূলক এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। ছাত্রলীগের এই কর্মকাণ্ডের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সন্ত্রাসবিরোধী আইন প্রয়োগ করে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করেছে।
ছাত্রলীগের ইতিহাস এবং বিতর্ক
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সংগঠনটি একসময় জাতীয়তাবাদী ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেও সময়ের পরিক্রমায় এর কর্মকাণ্ড নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা চাঁদাবাজি, সিট বাণিজ্য, হত্যাকাণ্ড এবং শিক্ষার্থী নির্যাতনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
বিশেষ করে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ড ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের একটি বড় উদাহরণ। ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী আবরারকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে হত্যা করে। এ ঘটনায় আদালত ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় দেন। ২০১২ সালে বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়েও একই ধরনের রায় দেওয়া হয়।
এছাড়াও ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ২০২৪ সালে আবারও একই ধরনের সহিংসতা চালায় ছাত্রলীগ, যা আরও ক্ষোভ সৃষ্টি করে।
নিষিদ্ধের পর ছাত্রলীগের প্রতিক্রিয়া
ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর বুধবার রাতে ছাত্রলীগের প্যাডে এক বিবৃতি পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। বিবৃতিতে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তকে ‘অবৈধ’ এবং ‘অসাংবিধানিক’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান স্বাক্ষরিত এই বিবৃতিতে বলা হয়, ছাত্রলীগ দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদযাপন
ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হওয়ায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে আনন্দ মিছিল এবং সমাবেশের আয়োজন করা হয়। বুধবার রাতে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে মিছিল শুরু করে রাজু ভাস্কর্যে এসে সমাবেশ করে। আন্দোলনকারীরা এই সিদ্ধান্তকে ছাত্র আন্দোলনের বিজয় হিসেবে দেখছে এবং ভবিষ্যতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার প্রত্যাশা করছে।