খুলনার দাকোপ উপজেলায় বেশ কিছু কাল সময় ধরে চিংড়ি মাছ মারা যাওয়ায় আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন চাষিরা। এ অবস্থায় চাষিদের জন্য আশার আলো হয়ে এসেছে ক্লাস্টার চাষ পদ্ধতি। খুলনা অঞ্চলের পাঁচ জেলায় ৩০০টি স্থানে প্রথমবারের মতো এ পদ্ধতিতে চাষ হচ্ছে। এতে উৎপাদন তিনগুণ বৃদ্ধির আশা মৎস্য অধিদপ্তরের। আগামীতে এ পদ্ধতিতে চাষ আরও সম্প্রসারণের দাবি সংশ্লিষ্টদের।
জলবায়ু পরিবর্তনের পাশাপাশি রোগমুক্ত পোনা না পাওয়া, ঘেরের গভীরতা কম থাকাসহ বিভিন্ন কারণে গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে খুলনা অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমছিল। এ কারণে একদিকে যেমন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিল কৃষক, তেমনি দেশের চিংড়ি রপ্তানি বাজারও সংকুচিত হয়ে আসছিল।
এ পরিস্থিতিতে চিংড়ির উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো খুলনা অঞ্চলে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে গলদা ও বাগদা চিংড়ি চাষের উদ্যোগ নেয় মৎস্য অধিদপ্তর। সাসটেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিসারিজ প্রকল্পের আওতায় একই স্থানে ৮টি ক্লাস্টার চিংড়ি ঘের পাশাপাশি রেখে চাষ করা হচ্ছে। দাকোপ উপজেলা মোট ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা মিলে ৮ টি ক্লাস্টার গঠন করা হয়েছে। সনাতন পদ্ধতিতে হেক্টর প্রতি যেখানে চিংড়ি উৎপাদন হয় ১০০ থেকে ২৫০ কেজি, সেখানে এ পদ্ধতিতে চিংড়ি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হেক্টর প্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ কেজি। এপ্রিলে পোনা ছাড়ার পর এরই মধ্যে ঘেরগুলোতে চিংড়ি পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। তাতে সন্তুষ্টির হাসি ফুটেছে চাষির মুখে। তবে পুকুর খননে সরকারি সহায়তারও দাবি তাদের।
দাকোপ উপজেলার তিলডাঙা ইউনিয়নে এই পদ্ধতিতে ঘের করছেন উজ্জ্বল রায়, রাজিব সানা, দেবব্রত মল্লিক। গত কয়েক বছর ধরে ঘের করে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছিলেন জানিয়ে তারা বলেন, ঘেরের পিছনে যে টাকা ব্যয় করতাম লাভ তো দূরে থাক, আসল টাকাই উঠতো না। মাছ পুষ্ট হয়ে ওঠার আগেই অর্ধেকের বেশি মাছ মারা যেত। তবে এ বছর মৎস্য অধিদপ্তর থেকে আমাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন একসঙ্গে ২৫টি ঘের আমরা পাশাপাশি রেখে চাষ করছি। এসব ঘেরের গভীরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে, মানসম্মত পোনা ছাড়া হয়েছে। এপ্রিলে পোনা ছাড়ার পর এখন অনেকটাই পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আশা করছি আগের থেকে অন্তত তিনগুণ বেশি মাছ আমাদের উৎপাদন হবে।
পানখালি ইউনিয়নে গলদা চিংড়ির চাষ করছেন চাষি কিশোর শেখ, গোপাল গাইন। তারা বলেন, ‘ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি ঘের করলে আমাদের খরচ সামান্য বেশি হয়, তবে লাভ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। আমরা ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করে এখন সন্তুষ্ট।’ তাদের এ সাফল্যে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষে আরও অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
রাশেদ ফকির বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে আমার পাশের গ্রামের অনেকেই চিংড়ি চাষ করে লাভবান হয়ে উঠছে। অথচ এ বছরও পানির অভাবে আমাদের অনেক চিংড়ি মারা গেছে। আমি আগামীতে এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করতে চাই।’
এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষকে আরও সম্প্রসারণ করার দাবি জানিয়ে দাকোপের পানখালি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘আমাদের এ ইউনিয়নে ক্লাস্টার পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে। কিন্তু এ ইউনিয়নের অধিকাংশ মানুষ চিংড়ির ওপর নির্ভরশীল। এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষকে যদি আরও সম্প্রসারণ করা যায় তাহলে আমাদের ইউনিয়নের আরও অনেক চাষি উপকৃত হবে।’
চিংড়ি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এ প্রকল্প জানিয়ে মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, সীমাবদ্ধতা দূর করে আগামীতে এ প্রকল্প আরও সম্প্রসারণ করা হবে।
এ ব্যাপারে দাকোপ উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তরের মেরিন ফিশারিশ কর্মকর্তা বিপুল কুমার দাস বলেন, ‘চলতি অর্থবছরে দাকোপে মোট ৮ টি ক্লাস্টার গঠন করা হয়েছে এবং ২ শত জনকে চিংড়ি চাষে উন্নত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। চাষিরা এখন এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে চিংড়ি উৎপাদনে সক্ষম হবে বলে তিনি মনে করেন।’
দাকোপ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রনজিত কুমার বলেন, ‘আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সেসব সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা এ চাষকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। যেসব জায়গায় এ পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ হচ্ছে সেসব স্থানে তিনগুণেরও বেশি চিংড়ি উৎপাদন হবে বলে আশা করছি। আগামীতে এ পদ্ধতি আরও বাড়ানোর লক্ষ্য আছে আমাদের।’
চলতি বছর সারাদেশে সনাতন, উন্নত সনাতন ও উন্নত পদ্ধতি মিলে ৩ হাজার ৮ শত ১০ হেক্টর জমিতে চিংড়ি চাষ করা হচ্ছে, যেখান থেকে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার কেজি। এ পদ্ধতিতে বছরে দাকোপে চিংড়ি উৎপাদন হবে ২৫শো থেকে ৩ হাজার মেট্রিক টন। তবে আধা নবিড় পদ্ধতিতে চিংড়ি চাষ করা হলে ৬ হাজার থেকে সাড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টন চিংড়ি উৎপাদন সম্ভব।